পরপারে ভালো থাকিস প্রিয় বন্ধু মুজাহিদ –মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

Blog, 14 March 2023, 146 বার পড়া হয়েছে,

কথা ছিল চট্টগ্রাম শহর ঘুরে দেখাবি! তার আগেই নিজেকেই চিরতরে আড়াল করে নিলি। পরপারে ভালো থাকিস প্রিয় বন্ধু মুজাহিদ।

গতবছর ৬ আগস্ট একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর ফোন দিলাম বন্ধু মুজাহিদকে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিল সে। আমার লোকেশন বলতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের সার্ভিস বাইক নিয়ে হাজির হলো। পুলিশের পোশাকে ওকে দেখতে সত্যিই খুব স্মার্ট লাগছিল।

পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে এসে আমাকে জেরা করতে শুরু করল- কখন আসলি, আগে জানালি না কেন ? রাতে এসে আমার এখানে তো থাকতে পারতি। শুয়ে-ঘুমিয়ে এসে আরাম করে পরীক্ষা দিতে পারতি। আমার অফিসের ঝামেলার কথা শুনে ছিল তারও খোঁজ খবর নিলো। আমি বললাম এমনিতেই আবেদন করেছিলাম, পরীক্ষা যে দেবো তার শিউর ছিল না। গতকাল রাতে হুট করেই চলে এসেছি। তাই কাউকে জানায়নি। এখানে এসে দেখে পরিচিত অনেকে পরীক্ষা দিতে এসেছে। তোর কথাও মনে পড়লো তাই ফোন দিলাম।

মুজাহিদ বলল, যাইহোক পরীক্ষা শেষ করে ফোন দিবি, সন্ধ্যার মধ্যে আমারো ডিউটি শেষ হয়ে যাবে, তারপর তোকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহর ঘুরে দেখাবো। আমি বললাম- না রে একদিনের ছুটি নিয়েছি। কালকে ডিউটি করতে হবে। এবার চলে যাই, আবার কখনো আসলে ২-১ দিন ছুটি বাড়িয়ে নিয়ে আসবো। তারপর তোর সাথে চট্টগ্রাম শহর ঘুরে দেখব। কিন্তু সে দেখা যে আর কোনদিন হবে না, তা তো সেদিন আর জানা ছিল না।

শরীর খারাপ নিয়ে গতকাল রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই বিভিন্ন বন্ধুদের আইডিতে মুজাহিদের মৃত্যুর খবর আঁতকে উঠলাম।

আমাদের বন্ধু মহলে মুজাহিদ একজন মেধাবী এবং ভালো ছেলে বলে সবার কাছে পরিচিত ছিল। গণিতের ছাত্র, খুব ভালো গণিত বুঝতে সে। সারাক্ষণ লেখাপড়া আর টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। বন্ধুরা যখন চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। তখনও সে ভালো একটি চাকরির আশায় একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল ।

অবশেষে ২০১৮ সালে চাকরি নামক সোনার হরিণ তার ভাগ্যে আসে। পুলিশের চাকরি, ট্রাফিক সার্জন। ভালো চাকরি পেয়েছে বলে আমরা সবাই বললাম দেরিতে হলেও মুজাহিদ তার যথাযোগ্য চাকরি পেয়েছে। মুজাহিদের চাকরি পাওয়ার কিছুদিন আগে তার বাবা মারা যায়। তাঁর চাকরির খবরে আমরা সবাই আফসোস করতে থাকলাম, আর কিছুদিন আগে চাকরিটা কনফার্ম হলে ওর বাবা এই সুখবরটি জেনে যেতে পারত।

রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং শেষ করে জানালো তার পোস্টিং হয়েছে চট্টগ্রামে। আমরা আবারও খুশি হলাম। চট্টগ্রাম থেকে মাঝেমধ্যেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসলে বন্ধুদের সময় দিত। আমরা মজা করে বলতাম- পুলিশের চাকরি পেয়েছিস, ঘুস টুস খেয়ে কয়দিনেই তো পেট ফুলে যাবে। বাড়ি-গাড়ি করে ফেলবি। অবশ্য আমরা জানতাম মুজাজিদ এরকম ছেলেই না। বরং বাংলাদেশ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট মুজাহিদের মত একজন সৎ, কর্মনিষ্ঠ, মেধাবী কর্মী পেয়েছে। নিজের যোগ্যতায় সে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে, এই বিশ্বাস আমাদের সবারই ছিল। কিন্তু চাকরি পাবার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় আমাদের সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরপারে পাড়ি জমানো সে। অল্প বয়সে, অসময়ে তাঁর এই চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হবে সবার।

গত বছর বিয়ে করেছিল মুজাহিদ। এবছর বিবাহ বার্ষিক আসার আগেই বিধবা হয়ে গেল তার প্রিয়তমা স্ত্রী। ভাবি সন্তান সম্ভবা। প্রিয় সন্তানের মুখ দেখার আগেই, তাকে কোলে নেয়ার আগেই, সন্তানের মুখে আধোঁ আঁধো স্বরে বাবা ডাক শোনার আগেই বন্ধুটি হারিয়ে গেল। চিরতরে এতিম হয়ে গেল হতভাগ্য অনাগত সন্তান। আহারে জীবন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। তার স্ত্রী, বৃদ্ধা মা, ছোট ভাইবোনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই।

খবরে প্রকাশ চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বন্দর বিভাগে কর্মরত সার্জেন্ট মুজাহিদ চৌধুরী গতকাল (১৩ মার্চ) সোমবার রাত ১১টার দিকে ডিউটি শেষ করে টোল রোড দিয়ে নিজ মোটরসাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরছিল। ফৌজদারহাট–বন্দর টোল রোডের ওয়াই জংশনের কাছে পৌছলে পেছন থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটি প্রাইভেট কার তাকে জোরে ধাক্কা দেয়। এসময় তিনি মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে।

অন্য মোটরসাইকেলে থাকা তার দুজন সহকর্মী গুরুতর আহত অবস্থায় মুজাহিদকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। নিহত সার্জেন্ট মুজাহিদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌর এলাকার মধ্যপাড়ায়। নগর পুলিশের উপ কমিশনার (ট্রাফিক–বন্দর) মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে দুর্ঘটনার পর চালকসহ প্রাইভেট কারটি আটক করা হয়েছে বলে জানান।

সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আমাদের প্রিয় বন্ধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলো। তা ভাবতেই কষ্টে আমাদের বুক ফেঁটে যাচ্ছে। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। বন্ধু মুজাহিদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

শোকাহত বন্ধু
-মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৪ মার্চ ২০২৩