একুশ আমার অহংকার ও গর্বের প্রতীক -জাকারিয়া জাকির

মতামত, 20 February 2023, 143 বার পড়া হয়েছে,
অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি একুশে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা। যে দিনটিকে আমরা পালন করে থাকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং একই সাথে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে। তাই প্রতিটি বাঙালি হিসেবে একুশ আমার চেতনা একুশ আমার অহংকার ও গর্বের প্রতীক।

জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি অমর, অক্ষয় এবং স্ব – মহিমায় প্রােজ্জ্বল একটি দিন। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় চেতনার এক উর্বর উৎস। তেরাে কোটি বাঙালির কাছে এ দিনটি অবিস্মরণীয়। ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামের সুমহান স্মৃতির মালায় গাঁথা এ দিনটিকে বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। রক্ত-রঞ্জিত এ একুশে ফেব্রুয়ারিতেই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বাংলার কিছু তরুণ তাদের তাজা প্রাণ অকাতরে আত্মোতৎসর্গ করে বাংলার ইতিহাসে লাভ করেছে অমরত্ব। এ চিহ্নিত দিনটি বাঙালি জাতীয়তাবােধের নবজন্মের দিন। এ দিনটির সাথে নির্যাতিত, শােষিত ও বঞ্চিত বাঙালি জাতির এক বিষাদবিধুর ইতিহাস জড়িত।

একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস খুবই বেদনাবহ। বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৯৫২ – এর ফেব্রুয়ারি অথবা পলাশ রাঙা ফাল্গুন এক ক্রান্তিলগ্ন। তখন পাকিস্তানি শাসনামল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হতেই পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকচলে পরিকল্পিত শােষণ ও বঞ্চনায় এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছিল ক্ষব্ধ। তদুপরি এদেশের চিরাচরিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত হানতে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঘোষণা দেয়’ উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর মূলে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষা, মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্য। তৎকালীন শাসকগােষ্ঠীর এটা ছিল বাঙালিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে ফেলার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

ভাষাপ্রেমী বাঙালির প্রতিরােধ আন্দোলনের মাধ্যমে শাসকগােষ্ঠীর অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেয় নি। এদেশের দামাল ছেলেরা এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠল। রাজরােষ ও চক্রান্তের বিরূদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াল। তারা গড়ে তুলল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। মিটিং, মিছিল আর শ্লোগানে মুখরিত করে তুলল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস। দুর্বার ভাষা আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ল শাসকগােষ্ঠী , জারি হলাে ১৪৪ ধারা । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তরুণদের দুর্জয় প্রতিবাদ মিছিলে ১৪৪ ধারার প্রতিরােধ ব্যহ চুরমার হয়ে গেল। আকাশে – বাতাসে ধ্বনিত হলাে ‘ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চইি। উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বসল ছাত্র – জনতার মিছিলে । রাষ্ট্রভাষা বাংলার ন্যায্য দাবির পবিত্ৰ মিছিল রঞ্জিত হলাে বুকের রক্তে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর প্রমুখ তরুণের বক্ষ – শােণিতে ঢাকার রাজপথে আঁকা হলো রক্তের আলপনা। অবশেষে রাজশক্তি মেনে নিল বাঙালির প্রাণের দাবি। বাংলা হলাে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।

জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য খুবই অর্থবহ। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একটি দিনই নয়। এখান থেকেই বাঙালির জাতীয় জীবনে যে গতিশীল চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তাই একদা পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। দিনের পর দিন বছরের পর বছর শােষিত, বঞ্চিত ও পােড়খাওয়া বাঙালি জাতি ইস্পাতকঠিন দৃপ্ত শপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাবেই বাঙালি জাতি এক জাগ্রত জাতি হিসেবে চিহ্নিত। এ জাগ্রত মানবশই বাংলাদেশের অন্যতম সক্রিয় সম্পদ। একুশের প্রেরণায় বাংলাদেশের কোটি কোটি মেহনতি মানুষ তাদের নিরলস শ্রম ও দেহ – নিঃসৃত প্রতিটি স্বেদবিন্দুর বিনিময়ে স্বকীয় মহিমায় বিভূষিত এক সােনার বাংলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। একুশ বাঙালির জাতীয়তা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এক অকাট্য দলিল।

মূলত বায়ান্ন সালে বাঙালি জাতীয়তাবােধের যে স্ফুরণ ঘটেছিল তা – ই ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ভাষাকে কেন্দ্র করেই গােটা জাতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছিল। একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই ‘৬৯ সালে বাঙালিরা অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে। ১৯৭০ সালে নির্বাচনি বিজয়ের পরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে বাঙালির ওপর চালানাে হলাে নির্মম হত্যাকাণ্ড তখন এদেশের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাড়াল। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর বাংলার মানুষ লাভ করল স্বাধীনতার সােনালি সূর্য। বায়ান্ন সালে যে চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল তারই পরিণতি ঘটে একাত্তরে। সেজন্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলন প্রাণশক্তি হিসেবে চিহ্নিত।

বাঙালি জাতির যতগুলাে অহঙ্কারের অনুষঙ্গা আছে তার মধ্যে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্যে অকাতর আত্মদানের নজির একমাত্র বাঙালিরই রয়েছে। বাঙালি জাতি ভাষার জন্যে আত্মদানের যে অহঙ্কার অর্জন করেছে তার প্রতি বিশ্ববাসী সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘােষণার মধ্যদিয়ে। শিকাগােতে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্যে আত্মদানের স্বীকৃতিসরূপ ১ মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। বাংলার মানুষের মাতৃভাষাপ্রীতির স্বীকৃতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এটা আমাদের জন্যে অবশ্যই অহঙ্কার ও গর্বের বিষয়। একুশ আমাদের দিয়েছে আত্মপরিচয়ের সম্মান, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবনমানের প্রেরণা। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিটা তৈরি হয়েছে একুশের কল্যাণেই।

একুশ দুর্জয় ও দুর্বার বাঙালি জাতির এক কালজয়ী অমর ও অক্ষয় কীর্তির স্মৃতিময় প্রামাণ্য সনদ। একুশের নির্যাসকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদেরকে মনে – প্রাণে খাঁটি বাঙ্গালি বলে প্রমাণ করতে হবে। কথনে, লিখনে, চিন্তনে ও পঠনে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করাই একুশের মূল দাবি।

জাকারিয়া জাকির,নির্বাহী সম্পাদক জনতার খবর