সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারেনি। প্রশ্নটি হচ্ছে কার মর্যাদা বেশি ? শিক্ষকের না’কি, পিতার।
একজন পিতা যিনি সন্তানের জনক, বিপদে-আপদে নানান ঝড়ঝাপটা মোকাবেলা করে তিনি সন্তানকে মানুষ করেন এবং পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করে যান। একইভাবে একজন শিক্ষক তিনিও মানব শিশুকে একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে আমাদের খাপ খাইয়ে চলতে শেখান। কিভাবে নিজেকে এবং অন্যকে ভালো রাখতে হবে তা শেখান। তাই শিক্ষকের ভূমিকা মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হয়তো কারো জীবনে বাবার ভূমিকা বেশি। কারো জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা বেশি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষ; মানুষ হয়ে ওঠে বাবা এবং শিক্ষকের সমান অবদানের ফলে। আর তাই এই কথা আমরা সহজেই বলতে পারি সৃষ্টিকর্তার পরে যদি মা’র স্থান হয় তাহলে তার পরের স্থান যৌথভাবে হবে বাবা ও শিক্ষকের।
কিন্তু নৈতিক অবক্ষয়ের এই যুগে বাবা এবং শিক্ষক দুজনই আজ আমাদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা এবং সেবা থেকে বঞ্চিত। তাই আজ বাবা বা শিক্ষকের প্রতি নানান অপমানকর ঘটনা প্রায়ই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রপত্রিকায় ভেসে ওঠে। যদিও কোন শিক্ষকদের সম্মান এতো সস্তা বা ঠুনকো নয় যে তাঁকে হত্যা করলে, তাঁর গলায় জুতোর মালা পড়িয়ে দিলে অথবা হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে জেলবন্দি করলে তাঁর মানহানি হবে। এসব ঘটনার জন্য শিক্ষকগণের কোন লজ্জা, ব্যর্থতা, দায় বা অনুশোচনাও থাকার কথা নয়। এই দায় আমার, আপনার, আমাদের সবার। এ লজ্জা আমাদের পুরো জাতির। শিক্ষকগণ হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। জাতির মেরুদন্ড তৈরীর কারিগর এই শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদা, সম্মান, সম্মানী এবং নিরাপত্তা দিতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মী ও রাষ্ট্রের। শিক্ষকদের সাথে দেশে এপর্যন্ত যা ঘটে যাওয়া যে কয়েকটি অনাকাঙ্খিত, ন্যাক্কারজনক, লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে গেছে তার কোন দায় মুক্তি নেই। হতে পারে না। পুরো জাতির সবাই মিলে ঐ শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চাইলেও এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।
তবে অদূরভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে তার জন্য আমাদের সবার অনেক কিছু করণীয় আছে। তার মধ্যে প্রথম করণীয় হচ্ছে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদেরকে উন্নতচরিত্র গঠনে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা। পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে, স্কুল-কলেজসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিলে এবং বিভিন্ন সভা সেমিনার করে হলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মায়, মমতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, একতা, সহনশীলতা, ধৈর্য, মানবিকতা, সেবা, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জীবের প্রতি দয়া, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, শালীনতা এবং সৃজনশীলতাসহ নানান নৈতিক চরিত্র গঠনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। পাঠ্যসূচিতেও এ ধরনের পাঠ থাকতে হবে।
এসব কিছু করার আগেও আরো একটি জরুরী কাজ করতে হবে। তা হচ্ছে দেশে টিকটক, লাইকির মত সোশ্যাল এ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করা। ফ্রী ফায়ার, পাবজিরমত অনলাইন খেলা গুলোকে বন্ধ করা এবং ইভটিজিং, ধূমপান বন্ধ করার মত কাজগুলো আগে করে নিতে হবে। এসব বন্ধ না করে তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা এবং গুণে গুণান্বিত করার চেষ্টা হবে তলাবিহীন ঝুড়ির মত।
আগের যুগে যেখানে আমরা শিক্ষকদের ছায়া মারাতেও ভয় পেতাম এখনকার যুগের ছেলে মেয়েরা শিক্ষকদের সামনেই নানান অপকর্ম করে বসে নির্ভয়ে। তার অরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে শিক্ষাগুরুদের হাতে শাসন দণ্ড বা বেত না থাকা।
বেত প্রসঙ্গে আমার স্কুল জীবনের প্রয়াত শিক্ষক জব্বার স্যারের কথা মনে পরে গেলো। প্রাইমারি স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন মো. আব্দুল জব্বার স্যার। তিনি গাইবান্ধার ফুলছড়ি ১নং মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমরা তখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি। সম্ভবত ৯৫ বা ৯৬ সালের কথা। সেসময় অসুস্থতার কারণে তিনি মারা যান। (আল্লাহ তায়ালা উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন-আমিন।) পরীক্ষার পর মারা যাওয়ায় আমাদের ধর্ম বিষয়ের খাতাগুলো তিনি দেখে যেতে পারেন নাই। তিনি মারা যাওয়ার পরে আমরা বন্ধুরা তার বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি থাকতেন একটি বাঁধের উপর তৈরি করা ছোট্ট কুঁড়েঘরে। সম্ভবত চাকরি সুত্রেই তিনি এখানে থাকতেন। আর পরিবার অন্য কোথায় থাকতেন। বাসায় পাটকাঠির বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম তাকের উপর অনেকগুলো পরীক্ষার খাতা পড়ে আছে। আমার ছোট্ট স্মৃতিতে এখনো সেই দৃশ্য জ্বলজ্বল করে। অনেক বছর আগের কথা কিছু তথ্য ভুল হলেও হতে পারে।
জব্বার স্যার ছিলেন খুবই কড়া মেজাজের মানুষ। আমরা বাচ্চারা সব সময় তাকে খুব ভয় পেতাম। টিফিনের বিরতিতে বা ক্লাসরুমে যখন শ্রেণি শিক্ষক থাকতো না আমরা তখন হৈচৈ করতাম, তখন কেউ যদি বলতো জব্বার স্যার ‘আসছে’ সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পুরো ক্লাস চুপ হয়ে যেতাম। স্কুলের আঙিনায় দৌড়াদৌড়ি, দুষ্টুমি করার সময় জব্বার স্যারকে দেখলে আমরা সতর্ক হয়ে যেতাম। মাঠ পরিস্কারের কাজে দলবদ্ধ ভাবে আমাদের বালক-বালিকাদের বসিয়ে দেওয়া হতো। একটু একটু করে ময়লা নিতে নিতে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে হবে এবং জমাকৃত ময়লাগুলো একটি ঝুড়িতে রাখতে হবে; এই ছিল নিয়ম। আমাদের মধ্যে যারা একটু চালাক ছিলাম আমরা একটু জোরে জোরে চলতাম, যাতে কম ময়লা তুলতে হয়। কিন্তু জব্বার স্যার যেদিন আমাদের সামনে উপস্থিত থাকতেন তখন আমরা আমাদের কাজ পুরোপুরিভাবেই করে নিতাম। পিটির সময় লাইন সোজা না করা, কথা বলা, ব্যায়ামের প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে না করা, সব কাজই ঠিক হয়ে যেত জব্বার স্যার সামনে উপস্থিত থাকলে।
এই যে আমরা স্যারকে ভয় পেতাম তার কারণ ছিল তার হাতে সবসময় একটি বেত থাকতো। সেই বেত দিয়ে আমরা স্যারকে কখনো কাউকে মারতে দেখিনি কিন্তু স্যারকে আমরা ঠিকই ভয় পেতাম। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল স্যারের হাতে যে লাঠি থাকতো তা ছিল নিতান্তই সাধারণ বেত। অনেক সময় শুধুমাত্র পাটকাঠি নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়াতেন আর তা দেখে আমরা সকলে ঠিক পাটকাঠির মতো সোজা হয়ে যেতাম।
আসলে শিক্ষগণ বেতের সদ্ব্যবহার করুক বা না করুক তাদের হাতে বেত থাকাটা বাঞ্চনীয়। এটা আমাদের মত দুষ্ট ছেলেমেয়েদের সোজা লাইনে আনতে এন্টিবায়োটিকেরমত খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বেত প্রসঙ্গে একটি হাদিসের কথা উল্লেখ করা যায়। হাদিসের রেফারেন্স যদিও আমার মনে নেই, তবে আমি কোথাও পড়ে ছিলাম যে, হাদিসে আছে “যেই ঘরে শাসনের জন্য বেত ঝুলিয়ে রাখা হয় সেই ঘরে আল্লাহতায়ালার রহমত থাকে।” আমার বাসাতেও ছোট্ট একটি বেত আছে, যেটা আমরা মাঝে মাঝেই আমার শিশু কন্যা তাসফিয়াকে দেখাই। তাসফিয়াকে কখনো মারতে হয়নি। কিন্তু এই বেত দেখাইলে সেও আমাদের ছোটবেলার মতো সোজা হয়ে যায়। আসল কথা হলো বাবা ও শিক্ষকের হাতে বেত, বিচারকের হাতে শাস্তির দণ্ড, রাষ্ট্রের আইন-কানুন এসবকিছু প্রায় একই জিনিস। প্রথমে এগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়। এর যথাযথ প্রদর্শন, ব্যবাহার না হলে কুলাঙ্গার সন্তান, কুছাত্র আর অমানুষের অভাব হবে না এই দেশে।
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, যে তোমাকে একটি অক্ষরও শিক্ষা দিয়েছেন তিনিই তোমার শিক্ষক। তোমার গায়ের চামড়া দিয়েও যদি তার তাঁর পায়ের জুতো তৈরী করে দাও, তবু তাঁর মযার্দা এবং প্রতিদান দেয়া সম্ভব হবে না। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ছাত্রবাস্থায় জুতো ছিলো না বলে খালি পায়ে ক্লাসে আসতেন। তাই দেখে উনার শিক্ষক তাকে এক জোড়া জুতা প্রদান করেন। পরদিন ইমাম আবু হানিফা (রঃ) আবারও খালি পায়ে জুতো পরে আসলে শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন তোমাকে গতকাল যে জুতো দিয়েছিলাম সেই জুতো পরোনি কেনো। আবু হানিফা (রঃ) উত্তরে বললেন, জনাব আপনার দেয়া জুতো আমার পায়ে পরার সাহস পাইনি, তাই সেই জুতো দিয়ে টুপি বানিয়ে মাথায় পরেছি। কোন শিক্ষকের মর্যাদা যদি এরকম হয় তাহলে শিক্ষকের মাথায় স্ট্যাম দিয়ে মেরে হত্যা করা দূরের কথা-বেয়াদবীর ভয়ে তারদের ছায়াও কেউ মারাবেনা। সবযুগে, সব দেশে, সকল জাতি ও ধর্মে শিক্ষকের মার্যাদা সমান ভাবে স্বীকৃত এবং মর্যাদার উচ্চ আসনে আসীন। তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে শিক্ষকগণ কেন নানানভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তা ভাবার সময় এসেছে।
দেশব্যাপী একজন শিক্ষক হত্যা, নির্যাতন, শিক্ষকের জায়গা দখল, শিক্ষকরে গলায় জুতার মালা, হাতে হ্যান্ড কাপ ও মামলায় দিলে জেলে প্রেরণ করার মত ঘটনাগুলোর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং দোষীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানাই।—-আমরা চাই দেশের সরকার, বিচার বিভাগ অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চত করুক। তাঁদের কেউ একজন শিক্ষকদের পাশে এসে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ভাষায় বাদশা আলমগীরের সুরে বলুক- ”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির”।
আজ ২৭ অক্টোবর শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে আমার শিক্ষা জীবনের সকল শিক্ষকগণের প্রতি জানাই অতল শ্রদ্ধা।
গত জুন মাসে দেশে কয়েকজন শিক্ষকদের এর ওপর ঘটা কয়েকটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার এই লেখা।
লেখক : মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, কবির কলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।