কঠিন শিলা বেষ্টিত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামা মিষ্টি ঝর্নার মত, সমতলের রুক্ষ-তপ্ত মৃত্তিকার বুক চিরে বেড়ে ওঠা তৃণর মত, ধীর পায়ে দুরুদুরু বুকে বাঁশের সাঁকো পাড়ি দেয়া বালিকা দলের মত, পরিবার-সমাজ-সংসার-ধর্ম আর রাষ্ট্রের নিয়ম-অনিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে ধনুক থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া তীরের মতো একদিন শুরু হয়েছিলো তোমাদের পথ চলা।
ধানের ক্ষেতের আল দিয়ে, লাউ-শীমের মাঁচার পাশ দিয়ে, পুকুর-ডোবার ধার ঘেঁসে, আম-কাঁঠালের ছায়া বেষ্টিত, শিউলি-জবা-বকুল ফুলের সুভাসিত বাতাসের আলিঙ্গন জড়ানো, নরম দূর্বাদলের পথ মারানো, আলতা মাখা তোমাদের পা একদিন বেঁছে নিয়ে নিয়েছিল অনিশ্চিত এক বন্ধুর পথ।
কুতকুত-বৌছি-লুকোচুরি-কানামাছি আর পুতুল খেলার সঙ্গি ফেলে, দলছুট হয়ে উড়তে থাকা পাখীর মত একদিন মুক্ত আকাশ বেছে নিয়েছিলে তোমরা। খুঁজে নিয়েছিলো নতুন সঙ্গী; নতুন আশ্রয়, নতুন খেলা।
পরিশেষে বহু চড়াই=উৎরাই পেরিয়ে, মরিচ-পিঁয়াজ মাখানো এক থালা পান্তা ভাত খেতে খেতে বিতৃষ্ণ মুখে পরিতৃপ্ত হাসির মতো ফুটে উঠলো তোমাদের আজকের এই বিজয়ফুল।
এই ছাদখোলা বাস যেন তোমাদের চলার পথের সকল বাধা-বিপত্তি, ব্যর্থতা, পরাজয় টিপ্পনীর খাঁচা ভাঙার প্রতীক। তোমাদের আটকে রাখার, বন্দি রাখার, আড়ালে রাখার, বঞ্চিত রাখার দেয়াল ভাঙার প্রতীক।
তোমাদের অর্জিত সোনালী ট্রফি ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেসব নারীদের বিজয়স্মারক, যারা লেখাপড়া করার জন্য, চাকরি বা ব্যবসার করার জন্য, নিজের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য, এতিম সন্তানকে খাইয়ে-পরিয়ে, পড়ায়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, গরীব অসুস্থ বাবা-মার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া, দুস্থ স্বামীর সংসারের হাল ধরা সকল মেহনতী, শ্রমজীবী, সংগ্রামী নারীদের সাহসের স্মারক।
প্রত্যন্ত, দুর্গম অঞ্চল থেকে উঠে আসা, পাহাড়ি-বাঙালি, হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম বা খ্রিস্টান ধর্মের এক অভূতপূর্ব সম্মিলন তোমরা এই এগারো রঙিন প্রজাপতির ঝাঁক। তোমরা দেখিয়ে দিলে একসঙ্গে মিলেমিশে আমরা বাঙালি, সম্প্রীতির বাংলাদেশ। সাফল্যের সোনার বাংলা।
কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বেগম রোকেয়া, রওশন আরা বাচ্চু, মমতাজ বেগম, সিতারা বেগম, তারামন বিবি, সুফিয়া কামাল, মাদার তেরেসা ও জাহানারা ইমামের মত মহির্ষী নারীগণ আজ তোমাদের সফলতা দেখে ওপার থেকে মুচকি হাসে।
বিশ্বমাঠ কাঁপিয়ে বাংলার রাজপথে তোমাদের বীরোচিত, বর্ণিলযাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তোমরা ফেলনা নয়, খেলনা নয়। তোমরা শুধু আদুরে দুলালী, অবহেলা পাত্রী নয়। তোমরা জয়ীতা, বিজয়ালক্ষী নারী। সাজিয়ে রাখা সো-পিস নয়।
রাগে, দুঃখে, অপমানে, লাঞ্চনায়, বঞ্চনায় নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে চাওয়া মেয়েদের কাছে তোমাদের জয়োল্লাস আজ বেঁচে থাকার উৎসাহ , প্রেরণার মন্ত্র। তোমাদের পায়ের জাদু আর ফুটবলশৈলীতে থমকে দাঁড়ায় তোমাদেরই অগ্রযাত্রার পথ রুদ্ধকারী মানব-দানব, হায়েনা,বখাটে, কাপুরুষের দল।
বিশ্বেরবুকে লাল সবুজের পতাকা মেলে ধরা তোমাদের আজকের এই বিজয় উল্লাস ১৬ কোটি বাঙালির ঘরে ঘরে একটি বার্তা পৌঁছে দেয় ‘মেয়েরাও পারে-মেয়েরাই পারে”।
অভিনন্দন জয়ীতা দল। অভিনন্দন খাঁচাভাঙা বাংলার বাঘিনীর দল। আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন, অভিবাদন তোমাদের।
উৎসর্গঃ সাফজয়ী নারী ফুটবল দল ও কলাকুশলী।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, কবির কলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।