ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ

জনতার কন্ঠ, 5 September 2022, 137 বার পড়া হয়েছে,
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দিন দিন বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ। এলাকা দাবড়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এরা কখনও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে, স্কুলগামী ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করছে, আবার কখনও বা বিভিন্ন স্পট থেকে ছিনতাই করছে। এদের কারণে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস শুরু ও ছুটির সময় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হালদারপাড়ার সূর্যমুখী কিন্ডার গার্টেনের সামনের রাস্তা, কাজীপাড়ার সাবেরা সোবহান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা, হালদারপাড়া গভর্নমেন্ট গার্লস উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা, মৌড়াইল অবকাশ এলাকার ফারুকী পার্কের সামনের রাস্তা, সরকারি মহিলা কলেজের হোস্টেলের সামনের রাস্তা, পাইকপাড়া আনন্দময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা, লোকনাথ উদ্যান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর আধুনিক মার্কেটের সামনের রাস্তাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে স্কুলগামী ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করে থাকে। বিশেষ করে ফারুকী পার্ক ও লোকনাথ উদ্যানে কিশোর গ্যাংয়ের পদচারণা থাকে তুলনামূলক বেশি। গত ১৫ দিনে লোকনাথ উদ্যানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রতিপক্ষ কিশোরদের মারধরসহ বেশ কয়েকটি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। চলতি বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এক কলেজছাত্রীকে মারধর করে তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।
জামান আহমেদ (ছদ্মনাম), একসময় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বছর কয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে নিজ এলাকায় সমবয়সী কিশোরদের নিয়ে কিশোর গ্যাংটি নিজেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

জামান বলেন, শুরুতে মূলত অন্যদের হামলা থেকে নিজেদের প্রটেক্ট করার জন্যই আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্রিত হই। পরে বেশ বড় একটা গ্যাং তৈরি হয় আমাদের”।

পরে আমরা দেখলাম, এটা একটা ট্রেন্ড। সবাই গুন্ডামি করছে, গ্যাং বানাচ্ছে, তখন আমরাও শুরু করলাম। তখন রাজনৈতিক এক বড় ভাইয়ের অনুসারী হলাম আমরা। এক সময় ৫/৬ টা হোন্ডা নিয়ে একসঙ্গে মুভ করতাম। ধীরে ধীরে বেশ বড় একটা গ্যাং তৈরি হয় আমাদের। বলছিলেন জামান আহমেদ। তবে গ্যাং তৈরি হওয়ার পর খুব দ্রুতই অন্য এলাকার গ্রুপগুলোর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় বলে জানিয়েছেন জামান।

অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও ঘটতো মারামারির ঘটনা। এক এলাকার ছেলে অন্য এলাকায় গেলে মারধরের ঘটনা ঘটতো। কাউকে গালি দিলে, ‘যথাযথ সম্মান’ না দেখালে, এমনকি বাঁকা চোখে তাকানোর কারণেও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। মেয়েলি বিষয় এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকেও অসংখ্য মারামারি হয়েছে বলে জানান জামান।

জামান আরো বলেন, আমাদের গ্যাংয়ে একসময় কয়েকটা আর্মস ক্যারি (অস্ত্র বহণ) করা শুরু করি আমরা। এসব দিয়ে মাঝে মধ্যে ফাঁকা ফায়ারিং করা হতো। তবে আমরা কাউকে গুলি করিনি কখনো।

আমাদের গ্যাংয়ের কয়েকজনের মধ্যে একটা সময় লোভ চলে আসে। গ্রুপটাকে কাজে লাগিয়ে টাকা আদায়ের ধান্দা শুরু করে কেউ কেউ। ছিনতাই শুরু হয়। আর মাদক নেয়া তো ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায়।

দুয়েকজন বিভিন্ন অপরাধে জেলও খেটেছে। ফলে নিজেকে রক্ষায় নিজের তৈরি গ্যাং থেকে একসময় নিজেই বেরিয়ে আসেন বলে দাবি করেন জামান।

ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহরের প্রায় সব এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। যার বর্তমান নাম “রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের অনুসারী দল”।

মূলত স্কুলে পড়তে গিয়ে কিংবা এলাকায় আড্ডা দিতে গিয়ে শুরুতে মজার ছলে এসব গ্রুপ তৈরি হলেও পরে একসময় মাদক, অস্ত্র এমনকি খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ে।

যেমন, “কাউকে পরোয়া করেনা ট্যাংকের পাড়ের বখাটেরা“, নবীনগরে কিশোর গ্যাং: জন্মদিনে গাছে বেঁধে মাথায় ডিম, আটা, ময়লা, এছাড়াও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সরকার পাড়ার রিমন হত্যা।

তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সদর থানার ওসি জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাংয়ের কোনো অস্তিত্ব এখনও খুঁজে পাননি তারা। কিন্তু দিন দিন বাড়ছে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা। তাই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছেন তারা।

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, চুরি, ছিনতাই ও যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। জেলায় কোনো কিশোর সংশোধনাগার না থাকায় বাধ্য হয়েই অনেক অপরাধীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে পুলিশ। কিছু অপরাধীকে মামলায় চালান দিয়ে আদালতে পাঠানো হলেও বয়স বিবেচনায় জামিন পেয়ে আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। এতে কিশোর অপরাধীরা পুলিশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সদর থানা সূত্রে জানা গেছে,গত ২০১৯ সালে ৫০টি মামলায় ৬৮ জন কিশোরকে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ।এছাড়াও অপরাধের ধরন ও মাত্রা বিবেচনা করে তাদের পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন-দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করেও অনেক কিশোর অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জরাচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধে জড়ানোর বিষয়টি স্বীকার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ শোভন বলেন, কিশোররা আবেগের তাড়নায় অপরাধের সাথে জরিয়ে পড়ছে, ছাত্রলীগ কখনো কোন অপরাধ বা অপরাধীকে সমর্থন করেনা।

সাবেক জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, স্কুল পড়ুয়া কোন ছেলে ছাত্র সংগঠনের অংশ নয়। তাদের পরিবারকে সন্তানের ব্যপারে যত্নশীল হতে হবে।

জেলা যুবলীগ এর সভাপতি প্রার্থী সাবেক ভিপি হাসান সারোয়ার বলেন, কম বয়সের ছেলেরা অপরাধের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি। তাই একটি মহল তাদের ব্যবহার করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করছে। সামাজিক ও পারিবারিক সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব।

স্থানীয়রা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা রাজনৈতিক নেতা এবং শহরের প্রভাবশালী পরিবারের বিধায় তাদেরকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। তাদের দৌরাত্ম্য তাই দিন দিন বাড়ছে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতায় আমরা আতঙ্কিত। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের তৎপরতা আরও জোরদার করার দাবি জানান।

-লেখক সাংবাদিক।