আখাউড়া স্থলবন্দরে ‘লাগেজ পার্টি’ স্থানীয় ৪/৫ জন সাংবাদিক,ব্যবসায়ীসহ কাস্টমস কর্মকর্তারা জড়িত

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, 18 March 2022, 419 বার পড়া হয়েছে,

মোঃ জুয়েল মিয়া,ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ‘লাগেজ পার্টির’ মাধ্যমে অবৈধভাবে নানা ধরনের পণ্য আনা যেন একেবারে ‘ওপেন সিক্রেট’। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযোগ উঠলে একাধিক কর্মকর্তা বদলি হলেও চিত্র একেবারেই পাল্টায়নি।

গতকাল বৃহস্পতিবার লাগেজ পার্টির একটি চালান আটক করতে অনেকটা বাধ্য হয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জ করলে কিছুটা পিছু হটেন তারা। তবে শেষ পর্যন্ত নানা টালবাহানার পর তারা নামকাওয়াস্তে শুল্ক আদায় করে পণ্য বহনকারীদেরকে ছেড়ে দেয়। ব্যাগেজ সুবিধার বাইরে পৌনে ৬ লাখ টাকার পণ্য আনার কথা উল্লেখ করে ৮৩ হাজার টাকা শুল্ক আদায় করে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওই যাত্রী বিশেষ ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে দেশে এসেছেন। সাংবাদিকদেরকে সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এসব পণ্য ব্যবসার জন্যই আনা বলে স্বীকার করেন। তবে পণ্যের মালিক তিনি নন বলে জানান। পণ্যগুলো চট্টগ্রামের নিয়ে যেতেন বলে উল্লেখ করেন।

যাত্রীদের ব্যাগেজ সুবিধার আওতায় উল্লেখ আছে, বিদেশফেরত যাত্রী যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় গৃহস্থালি বা অন্যবিধ সামগ্রি ১৫ কেজি নিতে পারবেন। এর বেশি হলে তাকে নিয়ম অনুসারে শুল্ক সুবিধা দিতে হবে। এক বছরে তিনি তিনবার ৪০০ ডলার পর্যন্ত দামের পণ্য নিয়ে যেতে পারবেন।

একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে ধনঞ্জয় দে ও রূপা দে নামে দুই ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাদের কাছে বড় আকারে পাঁচটি ব্যাগ ছিলো। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বিষয়টি গোপনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। প্রথমে টালবাহানা করলেও একপর্যায়ে ব্যাগে কী আছে জানতে চাওয়া হয়। এরই মধ্যে তাদের ব্যাগ যেন তল্লাশি না করা হয় সেজন্য ছুটে আসেন একটি জাতীয় দৈনিক ও বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক। সামান্য জরিমানা করা হবে শর্তে ধনঞ্জয়কে দিয়ে ওই সাংবাদিকের সামনে ব্যাগ খোলান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে এ প্রতিবেদকসহ স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক কাস্টমস কার্যালয়ে উপস্থিত হন।
সাংবাদিকদের উপস্থিতির পরই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক পণ্যের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। একেকজন যাত্রী ৪০০ ডলারের সমপরিমাণ পণ্য কিংবা ১৫ কেজি ওজন পর্যন্ত পণ্য নিতে পারবেন বলে জানান তিনি। সেই হিসেবে অতিরিক্ত ৬৫টি থ্রিপিস ধনঞ্জয়দের বহন করা লাগেজে পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। সাংবাদিকরা এ নিয়ে আপত্তি তুললে তড়িঘড়ি করে আবার ধনঞ্জয়কে দিয়েই ব্যাগের কাপড় গণনা শুরু করান। তখন তিনি মোট ৯৯টি পোশাক অতিরিক্তি বলে জানান। সাংবাদিকরা আবার চ্যালেঞ্জ করলে পাঁচটি ব্যাগ খুলে প্রায় ২৯৪টি পোশাক পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭০টি থ্রিপিস, ২০৬টি টি-শার্ট, ১৮টি জিন্স প্যান্ট রয়েছে। ব্যাগে একাধিক মদের বোতলও পাওয়া যায়।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, করোনা শুরুর পর থেকে ভারত থেকে এভাবে পণ্য আসা শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সেটি বেড়ে যায়। বিশেষ করে কলকাতা থেকে পোশাকসহ কসমেটিকস। এক্ষেত্রে সেখানকার ব্যবসায়ীরা লোক দিয়ে এসব পণ্য পাঠান। এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি স্থানীয় চার-পাঁচজন সাংবাদিক এর সঙ্গে জড়িত। কাস্টমসসহ বন্দরের সংশ্লিষ্টদেরকে ম্যানেজ করে তারা অবাধে এসব পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। ৫০ এর অধিক ভারতীয় দম্পতি এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।

সূত্রটি জানায়, কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এরই অংশ হিসেবে একজন আরেকজনের পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবারও একটি পক্ষ এ পণ্য ধরিয়ে দেন। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় সাংবাদিকদেরকে ব্যবহার করে এসব পণ্য দেদারছে নিয়ে যাচ্ছেন। বন্দর এলাকার এক সাংবাদিক সরাসরি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার শ্বশুরবাড়ি এলাকাতে নিয়মিতই পোশাক-জাতীয় পণ্য পাঠান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতীয় নাগরিক ধনঞ্জয় দে প্রথমে স্থানীয় ওই সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে তার শিখিয়ে দেওয়া এক ব্যক্তির নাম মালিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ব্যবসার জন্যই এসব পণ্য দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু পণ্য বহন করি। আর কখনো বাংলাদেশে আসিনি। আমাকে চট্টগ্রাম যেতে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না। আমার ছবি আপনারা কোথাও দেবেন না। তাহলে মুখ দেখাতে পারবো না।

সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক বলেন, ওই যাত্রী কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে পণ্য নিয়ে যেতে চাইছিলেন। তার ব্যাগ তল্লাশি করে ব্যাগেজ সুবিধার বাইরে বাইরে যা পাওয়া গেছে সেগুলোতে শুল্ক ধরা হয়। ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে ঢোকার পথে এ সুবিধা পাবেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছু বলেননি। পরে তিনি যে নিয়ম পাঠান সেটিতে বিদেশফেরত যাত্রী ব্যাগেজ সুবিধা পাবেন বলে উল্লেখ থাকতে দেখা যায়।