মানুষ শান্তিপ্রিয় জাতি। যুদ্ধ করা মানুষকে মানায় না। তবুও কখনাে কখনাে মানুষ পাশবিক যুদ্ধে মেতে ওঠে। রক্তে রঙিন হয় সভ্যতার সুচারু ক্যানভাস। এমন ধ্বংসযজ্ঞ সভ্য মানুষের কাম্য হতে পারে না। যুদ্ধ নিয়ে লিখতে কারো ভালো লাগে না। কারণ যুদ্ধ কখনোই কোনো সুফল বয়ে আনে না। যুদ্ধ শুধু আনে ধ্বংস আর মৃত্যু। আনে হাহাকার আর দারিদ্র্য। যুদ্ধে যে দেশ নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেয়, প্রকৃতপক্ষে সে বিজয় দেশটির কোনো স্থায়ী সাফল্য এনে দেয় না। আপাতত বীরত্বের খেতাবে ভূষিত হলেও বৃহত্তর অর্থে সেটা তার ক্ষতির কারণই হয়। তাই যুদ্ধ এড়িয়ে দু’পক্ষের বিরাজমান সমস্যাগুলো কূটনীতির মাধ্যমে সমাধা করাই বুদ্ধিমানদের কাজ। কিন্তু যারা ক্ষমতার চশমায় মোহগ্রস্ত তারা এটা বুঝতে চান না। তাদের কাছে নিজের মসনদ, প্রতিপত্তি এবং জেদই আসল বিষয়।
যুদ্ধে জড়ানোর ভালো সময় বলতে কিছু নেই। তবুও বর্তমান সময়টা যে একেবারেই বৈরী, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। চলমান অতিমারীর কারণে বিশ্ব এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি একেবারেই পর্যুদস্ত। উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি অচল ছিল এ সময়ে। অগণিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে। ২০২০ সালেই বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদন ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। প্রাকৃতিক এ সংকট কাটিয়ে বিশ্ব যখন মন্থরগতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সেই গতি আরো মন্থর করবে।
রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম৷ ইউক্রেনের সাথে আরো কম৷ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য৷ বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশই হলো তৈরি পোশাক ও বস্ত্র সামগ্রী আর রাশিয়া থেকে আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে সবজি ও তেল৷ একই সময়ে ইউক্রেন থেকে ৫১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি করা হয়েছে ৩১ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য৷ আমদানির বেশিরভাই হলো সবজি৷
তবে যুদ্ধের কারণে দুই দেশের সঙ্গে মোট ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য বাণিজ্যের পুরোটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে৷ এমনিতেই যুদ্ধকালীন সময় বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়, বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়৷ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তাতে করে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে যাচ্ছে৷
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, যে চালানগুলো রাশিয়া অভিমুখে রয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাকমতো পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হতে পারে, এমনকি বাধাগ্রস্তও হতে পারে৷ তবে পণ্য রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্য মূল্য পেতে আরো বেশি সমস্যা হতে পারে৷ আর নতুন করে রপ্তানির কার্যাদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে৷ সব মিলিয়ে রাশিয়ায় ৬০ কোটি ডলারের বেশি বার্ষিক রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে৷
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না৷ বরং প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা বাড়ছে৷ আর রাশিয়ার যেসব ব্যাংক এখনো সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি বা কোনো নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি, সেসব ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হলেও পশ্চিমা ব্যাংকগুলো বা করেসপনডেন্স ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে যা লেনদেনকে কঠিন বা ব্যয়বহুল এমনকি অনিশ্চিত করে তুলতে পারে৷
জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, ইউক্রেন সংকট থেকে প্রাথমিকভাবে আঘাতটা আসবে খাদ্যপণ্য, বিশেষত গম এবং জ্বালানি তেলে৷ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে গমের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন৷ চলমান সংঘাতের সাথে রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমাদের বিধিনিষেধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের ও তেলের সরবরাহ কমে যাবে, বাড়বে দাম৷ তখন বাংলাদেশকেও বেশি দামে এগুলো কিনতে হবে, যা দেশের ভেতর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে৷
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) গত বছর নভেম্বর মাসে দেশের ভেতর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে উচ্চ হারে, যা অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে পরের মাসেই৷ এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে৷ দাম যদি নেমে না আসে, তাহলে বিপিসি শিগগিরই আবার দাম বাড়াবে কিনা তা আপাতত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না৷ কিন্তু বাড়ালে মূল্যস্ফীতিও আরেকদফা বেড়ে যাবে, যা মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা আরো কমিয়ে দেবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে যে, চলতি অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে৷ পাঁচ দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার আটকে রাখা কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
ড. আবিদ আরো বলেন, ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিভাবে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ কার্যকর করবে, তার ওপর নির্ভর করবে তাদের বাণিজ্য নীতির কিছু সাময়িক পরিবর্তন৷ সেই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা এখনই বোঝার কোনো উপায় নেই৷ তবে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) এর উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ মনে করেন, যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের সামগ্রিক চাহিদা কমবে, কেননা, ইউরোপের জ্বালানি তেলের বড় উৎস হলো রাশিয়া৷ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ব্যাহত হলে ইউরোপকে বিকল্প উৎস থেকে বাড়তি দামে তেল কিনতে হবে৷ তাতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরো বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে৷ তেলের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, বিশেষত গমের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, যা খাদ্যের দাম বাড়াবে৷ তেল ও খাদ্যের বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্যান্য ব্যয়ে কাটছাঁট করবে৷ তার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিতে পড়তে পারে৷
বাংলাদেশের মোট বিশ্ব বাণিজ্যের এক-পঞ্চমাংশ সম্পন্ন হয় ইইউভুক্ত দেশগুলোর সাথে৷ আর ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ হলো বস্ত্র ও তৈরি পোশাক৷ মনজুর আহমেদ এও মনে করেন যে সুইফট থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ রাশিয়ার সাথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় অসম্ভব করে তুলবে৷ যুক্তরাষ্ট্র আরো কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে৷ তার মানে হলে, খুব কম দেশের পক্ষেই এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে পারবে৷ তা করতে গেলে সে দেশও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে৷
এমতাবস্থায় রাশিয়ার অর্থায়নে চলমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজে বাধা তৈরি হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন মনজুর আহমেদ৷ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়৷ আর এই ঋণের টাকা আসছে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে৷ কেননা, বাংলাদেশ রুবলের বদলে ডলারে ঋণের অর্থ নিতে চেয়েছে৷ কিন্তু সুইফট থেকে রাশিয়া আংশিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও এই টাকা আর এভাবে আনা যাবে না৷ সেক্ষেত্র বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে৷
অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই কারেন্সি সোয়াপ বা দুই দেশের মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পন্ন করার একটি রূপরেখার কথা ভাবা হচ্ছিল বলে জানা গেছে৷এই ব্যবস্থায় দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ব স্ব দেশের রপ্তানিকারকদেরকে তাদের স্বদেশীয় মুদ্রায় পাওনা মিটিয়ে দেবে আর তিন মাস অন্তর হিসেব সমন্বয় করবে৷ তবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো এখন যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা পাশ কাটিয়ে কারেন্সি সোয়াপ করে বাণিজ্য কতটা করা যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে৷
এদিকে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ বাংলাদেশে যেহেতেু পণ্য রপ্তানির পুরোটাই এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে করে থাকে, তাই এগুলো রপ্তানির খরচ বাড়াবে না৷ তবে আমদানির বেশিরভাগই সিএন্ডফিভিত্তিতে (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেই্ট) হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে, যার প্রভাব পড়বে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যে৷ ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়াবে৷ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধ্বে বাণিজ্য ঘাটতি এক হাজার ৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার৷ পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকারে আরো দরপতন ঘটাতে পারে৷
তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল মাত্র ১৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার৷ ইউক্রেন থেকে কোনো এফডিআই ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর আর আসেনি৷ আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল মাত্র ১১ লাখ ৫০ ডলারের বিনিয়োগ৷ সে হিসেবে সরাসরি রুশ বিনিয়োগ নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেবে না৷
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে সংকট বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ববাজারে ঝড় তুলেছে। সংকটটি জি-৭ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের একটি যৌথ বিবৃতি জারি করতে প্ররোচিত করে, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে তবে তার জন্য ‘ব্যাপক’ অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবরোধ করা হবে। কিন্তু এর ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় ইউরোপ বেশি পরিমাণে প্রভাবিত হবে। রাশিয়া বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক, যা ২০২০ সালে সরবরাহের প্রায় ১৭ শতাংশ। রাশিয়া তার উৎপাদনের ৩৫ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি করে এবং প্রায় ৭০ শতাংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে পাঠায়, যার বেশিরভাগই ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় হলো নর্ড স্ট্রিম ১, যার ক্ষমতা বার্ষিক ৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়া থেকে জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস স্থানান্তর করার জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইনকে বন্ধ করার কথা বলেছেন। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোল্টজ তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হননি, কারণ জার্মানির প্রাকৃতিক গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি রাশিয়া সরবরাহ করে। তা ছাড়া রাশিয়া জার্মানির কয়লা আমদানির অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করে। রাশিয়ান পাইপলাইন রপ্তানিতে বাধা, তেলের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের জন্য ব্যারেলপ্রতি ৯৫ ডলার, যা এই বছরের শুরুতে প্রায় ৭০ ডলার থেকে বেড়েছে। গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে ইউরোপীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে। যা তেলের দামকেও প্রভাবিত করবে, তেলের দাম $১২০ বিবিএল হতে পারে। রাশিয়ান তেল রপ্তানি অর্ধেক হলে ব্রেন্ট তেলের দাম ১৫০ বিবিএল ডলার হবে। রাশিয়া বিরল খনিজ এবং ভারী ধাতুগুলোর একটি প্রধান রপ্তানিকারক- যেমন বিমানে ব্যবহৃত টাইটানিয়াম। রাশিয়া বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্যালাডিয়াম সরবরাহ করে। ইউক্রেনের সংঘর্ষ ইউক্রেনীয় শিল্পগুলোকেও ব্যাহত করবে। ইউক্রেন নিয়নের একটি প্রধান উৎস, যা সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর এবং মহাকাশ শিল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরে সাপ্লাই চেইন বিঘিœত হবে। ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয় দেশেই প্রচুর পরিমাণে সার উৎপাদিত হয়। এই রপ্তানিতে বাধাগুলো বেশিরভাগই ইউরোপের কৃষিকে প্রভাবিত করবে, তবে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার ধাক্কা বিশ্ববাজারে আঘাত করতে পারে। নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি নির্ভর করবে বিশ্বনেতারা কোন বিকল্পটা বেছে নেবেন তার ওপর। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক কার্যক্রম প্রমাণ করে যে রাশিয়া এরই মধ্যে একটি গর্হিত বিকল্প বেছে নিয়েছে। তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সরকার ‘নিষেধাজ্ঞা’ বিকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে, যা শুধু রাশিয়ার নয়, তাদের নিজেদেরও ক্ষতি করবে। এখন দেখার বিষয় রাশিয়া তাদের প্রতীকীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে বা রাশিয়ার প্রতিপক্ষ আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কিনা। নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া যত বাড়বে রাশিয়ার জন্য তার পরিণতি হবে ততই ভয়াবহ। তবে বিশ্ব অর্থনীতিও এ ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয় মোটেও।
যুদ্ধ মানুষের সবচেয়ে পুরানাে কৌশল। সভ্যতা গড়ে ওঠার আগেই মানুষ প্রভাব বলয় বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করেছে। আদিম যুগের মানুষ খাবার শিকার নিয়ে লড়াই করেছে। শিকারের ভাগ একান্ত নিজের করে পেতে নিজেদের মধ্যে বাহুবলের প্রতিযােগিতা হয়েছে। ধীরে ধীরে যুদ্ধের কৌশল নানাভাবে বদলেছে। তরবারি থেকে এটম বােম পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের ইতিহাসে এমন অনেক যুদ্ধ এসেছে, যেগুলােকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ কিংবা স্বাধিকার অর্জনের যুদ্ধ। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ সব সময়ই লেগে ছিল, এখনও লেগে আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের দুটি নতুন শক্তির উদয় হয়। সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখের অধিক লােক মারা যায়। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ বেসামরিক লােক। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ লােক চিকিৎসা শিবিরে প্রাণ হারায়। লােকজন, শহর, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সারা বিশ্বের ভয়ংকর ক্ষতি হয়। পারমাণবিক বােমাসহ অনেক নতুন নতুন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
১৯৪৫ সালে যুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি অনেক রাষ্ট্রই রক্ষা করেনি। ভিয়েতনামের যুদ্ধে দেড় কোটি বােমার আঘাতে মাটি তামা হয়ে যায়। কম্পােচিয়ার বনাঞ্চল তৃণশূন্য হয়ে যায়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ, ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধ, ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এবং বর্তমানে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের শেষ নেই।