বিএসএফের বাধায় বন্ধ রেলের নির্মাণকাজ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, 16 February 2022, 208 বার পড়া হয়েছে,

ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার ‘ডাবল লাইন’ রেলপথ প্রকল্পের নির্মাণকাজ ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের বাধায় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। একাধিকবার খরচ ও সময় বাড়ানোর পরও বাধার কারণে কাজ শেষ হচ্ছে না।

ডিপিপির (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) অতিরিক্ত খরচের কারণে এখন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এ কারণে ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রেখে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনে। কেবল খরচ বাড়ানোর মাধ্যমেই সমাধান হচ্ছে না। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেলপথের নির্মাণকাজ সচল করতে নানামুখী চেষ্টা করা হয়। বিএসএফের তিন দফা বাধায় কসবা ও সালদা নদী স্টেশনসংলগ্ন কাজ আটকে আছে। এদিকে কাজ বন্ধ থাকায় ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

এ নিয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক এবং চিঠি চালাচালি করেও সমাধান করতে পারেনি রেলপথ মন্ত্রণালয়। ভারতীয় হাইকমিশনারকে লিখিতভাবে অবগত এবং বৈঠক করেও সুরাহা হয়নি। এ অবস্থায় আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। এ জন্য রেলওয়ের আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্প পরিচালককেও বৈঠকে অংশ নিতে মনোনীত করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসংক্রান্ত চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকার ১৫০ ইয়ার্ডের মধ্যে কোনো উন্নয়নকাজ করতে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে সমস্যার নিষ্পত্তি করা যায়। কেবল রেলওয়ে নয়, সীমান্ত এলাকায় উন্নয়নকাজে বিঘ্ন ঘটে, এমন অন্যান্য সংস্থাও তাদের সমস্যা তুলে ধরতে পারে আসন্ন বৈঠকে। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকে রেলের আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পের বিদ্যমান সমস্যা গুরুত্ব পাবে। বিএসএফের আপত্তির মুখে রেলপথ নির্মাণে বাধার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরার কথা রয়েছে সেখানে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের কিছু অংশে বিএসএফ কাজ করতে বাধা দিয়েছে। এ নিয়ে অনেক চেষ্টা চলছে। কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের আশা করছি। এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনারকে লিখিতভাবে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক চেষ্টা অব্যাহত আছে। ভারত একটি প্রতিবেশী দেশ। বন্ধুপ্রতিম এ দেশের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দিল্লিতে ২২ ফেব্রুয়ারির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তা তুলে ধরা হবে। আমরা আশা করি সমাধান হয়ে যাবে।

জানা গেছে, বিএসএফের আপত্তির কারণে সালদা নদী এবং কসবা স্টেশন এলাকায় কাজ বন্ধ গত বছর থেকেই। সালদা নদীর স্টেশন এলাকার নির্মাণাধীন ২৬১ নম্বর সেতুর কাজ প্রথম বন্ধ থাকে গত বছরের ২৫ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর ওই বছরের ১০ জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখা হয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পর কাজ করতে গেলে পুনরায় বাধা আসে। একপর্যায়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ভারতীয় হাইকমিশনারকে বিষয়টি অবহিত করে ডিও লেটার দেন। একই বছরের ২ আগস্ট ও ৩১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও সুরাহার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। এর পর গত ১ জানুয়ারি বিজিবির লেফটেনেন্ট কর্নেল পর্যায়ের কর্মকর্তার টেলিফোনে আলোচনার মাধ্যমে সালদা নদী স্টেশনসংলগ্ন কাজ শুরু হয়। তার পর ১৩ জানুয়ারি পুনরায় কাজ বন্ধ করে দেয় বিএসএফ।

অন্যদিকে কসবা স্টেশন এলাকার কাজ আজ পর্যন্ত শুরুই করা যায়নি। ফলে সার্বিকভাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে করে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। একই কারণে ঠিকাদারের পক্ষ থেকে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয় গত ২ ফেব্রুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়ে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় (পিএসসি) তুলে ধরা হয়। এ নিয়ে বৈঠকে উপস্থিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) যুগ্ম সচিব সমস্যা সমাধানে দ্রুত বিষয়টি ইআরডির সচিবকে জানাতে তাগিদ দেন। তা ছাড়া প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাবে সব যুক্তি তুলে ধরতে পরামর্শ দেন ইআরডির প্রতিনিধি।

সূত্রমতে, নির্মাণকাজের চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পের সব এলাকা বাধামুক্তভাবে হস্তান্তর করার বিধান রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতাসহ মাঠপর্যায়ে অন্যান্য জটিলতায় বাধা দূর করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ চাইলেও প্রকল্পে এর সংস্থান রাখা হয়নি। এ জন্য করণীয় নির্ধারণে বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের ব্যাপারে পিএসসি সভার সবাই একমত পোষণ করেন।

আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পের ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পের মেয়াদও একই সময়ে শেষ হবে। প্রকল্পের ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সেবা বাবদ প্রায় ২৫ কোটি টাকার দরকার হবে। এ জন্য দাতা সংস্থা এডিবির চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে নির্মাণকাজের জন্য ২০১৬ সালের ১৫ জুন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিটিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করে রেলের সঙ্গে। ওই বছরের ১ নভেম্বর থেকে মাঠপর্যায়ে তারা কাজ শুরু করে। আর নির্মাণকাজ তদারকির জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি চুক্তি হয়। এ ছাড়া দাতা সংস্থার শর্তানুসারে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজে এনজিও হিসেবে ‘সমাহার’ নামের প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হয়। এখন অতিরিক্ত সময়ের কারণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়েছে, যা ডিপিপিতে সংস্থান নেই। তারা বিলের জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান ছাড়া ভেরিয়েশনও সম্ভব নয়।

এর চেয়ে বড় কথা হলো, ডিপিপি সংশোধন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া আউটসোর্সিং খাতে নিয়োজিত জনবলেরও টাকার সংস্থান নেই। আবার সমাহারের ‘ভেরিয়েশন’ প্রস্তাব নতুন করে দাখিল করা হয়। এটিও ডিপিপির সংস্থানের চেয়ে বেশি ব্যয়। মোট কথা প্রকল্পের নির্মাণকাজ তদারকির জন্য নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তির সংস্থান অনুযায়ী বরাদ্দ নেই। ফলে বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এখন ‘ভেরিয়েশন’ প্রস্তাব ও সে অনুযায়ী খরচ অনুমোদন দেরি হলে তদারকি সেবা বন্ধ করে দিতে পারে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি চুক্তি বাতিলের আশঙ্কাও করেছেন প্রকল্প পরিচালক। এতে করে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়বে।

অপরদিকে ভূমি অধিগ্রহণে পুনর্বাসন কার্যক্রম ব্যাহত হলে ঠিকাদারকে জায়গা বুঝিয়ে দিতে দেরি হবে। এতেও খরচ ও সময় বাড়বে। তাই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও পুনর্বাসন কাজে নিয়োজিত এনজিওর দাখিল করা ৫৩ কোটি ৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা ও ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকার ভেরিয়েশন প্রস্তাব দুটি দ্রুত অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। আউটসোর্সিংয়ে জনবলসহ সিডি ভ্যাট সব মিলে ৩২৫ কোটি ২২ লাখ ৭২ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হচ্ছে অনুমোদনের জন্য। ডিপিপি সংস্থানের অতিরিক্ত ব্যয় মোট ব্যয়ের ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রেখে এ অনুমোদন চাওয়া হচ্ছে। পরে ডিপিপির সংশোধন করা হবে।

অথচ গত বছরের ১৫ জুলাই রেল মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, পরিকল্পনা কমিশনের শর্তসাপেক্ষে (‘প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে’) বাস্তবায়ন মেয়াদ দ্বিতীয়বার দুই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তার আগে এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।