রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীর সূঁতিকাগার ব্রাহ্মণবাড়িয়া -এস এম শাহনূর 

জনতার কন্ঠ, 16 February 2022, 378 বার পড়া হয়েছে,
পৃথিবীর নানা দেশে ভাষা ও সাহিত্য গবেষণাকেন্দ্রিক বহু প্রতিষ্ঠান আছে,বহু দিবসও আছে। কিন্তু কোনোটিরই  ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মতো মহান সংগ্রামী-রক্তাক্ত পটভূমি নেই।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, তাঁকে বলা হয় বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাষাসৈনিক। ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তরে রামরাইল গ্রামে জন্ম নেন ধীরেন্দ্রনাথ। ৭১ সালে শহীদ হন বিখ্যাত এ মনীষী। ১৯৪৮ সালের ২৫ অগাস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উত্থাপন করেন তিনি।
এটাই ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার গণআকাঙ্খার সূচনা। এরপর তৈরি হলো একের পর এক ইতিহাস। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে রাজপথে রক্ত ঢেলে দিলেন। অসংখ্য ভাষাসৈনিকের সংগ্রামের ফলে আমরা আজ মায়ের ভাষা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। সেই মাতৃভাষার প্রথম দাবিদার হলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
‘১৯৫২ সালের এই মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে সমগ্র বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এটাও বাংলাদেশের জন্য কম গৌরবের কথা নয়। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্যও একটি বিরাট গৌরবের বিষয় এই যে, ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নায়ক আজকের জাতীয় নেতা অলি আহাদের জন্মস্থানও এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। অলি আহাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কারণেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ফলেই সংঘটিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ঘটনা। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের জনক এবং গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় যখন ঘোষণা করেন যে, `Urdu and Urdu shall be the state language of pakistan. সে সময় রেসকোর্স ময়দানের এক প্রান্তে সহপাঠীদের নিয়ে দাঁড়ানো এই অলি আহাদই প্রথম `No No বলে প্রতিবাদ করেছিলেন।’
১৯৪৭ সালে তমুদ্দন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্ত কমিটির আহবানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ২১ ডিসেম্বর তৎকালীন সরাইল থানা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি তাদের এক সভায় বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৫ জানুয়ারি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় এ বিষয়ের খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটা সরাইলের জন্য এবং গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য এক গৌরবের বিষয়। সরাইল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী উত্থাপিত হওয়ার বিষয়টি অনেকেই এখনো জানেন না। গত কয়েক বছর ধরে সরাইল প্রেসক্লাব এ দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালন করে আসছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেনস্টেশনটিও বুকে ধারণ করে আছে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের অমলিন গৌরব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিবৃত্তের লেখক  মুহাম্মদ মুসা বলেন, ‘সেদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। অলি আহাদ ভাই ঢাকায় আছেন। তিনি আমাদের জন্য বার্তা পাঠাবেন। এই ভরসা নিয়ে মাঝরাতে আমরা অনেক ছাত্রছাত্রী অবস্থান নিয়েছি এই স্টেশনে। রাত একটায় চট্টগ্রাম মেইল এসে থামল। ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রকে দিয়ে অলি আহাদ ভাই আমাদের জন্য এক রক্তাক্ত বার্তা পাঠিয়েছেন—শহীদ বরকতের গায়ের জামার রক্তে ভেজা এক টুকরো কাপড়।
‘ততক্ষণে এই স্টেশন ছাত্রজনতায় কানায় কানায় পূর্ণ। টগবগিয়ে উঠল সবার গায়ের রক্ত। বরকতের রক্তভেজা জামার টুকরো হাতে নিয়ে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কে একজন চিৎকার দিয়ে বলল, “চুপ করো। এটা কান্নার সময় নয়। এটা প্রতিশোধের। প্রতিরোধের সময়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতেই হবে।”
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টেশন থেকে সরে এসে গোপন বৈঠকে শিমরাইলকান্দি শ্মশানঘাটে আমরা কয়েকজন সদস্য মিলিত হলাম। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে পরদিন সকাল ১০টায় খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিপুল ছাত্রজনতা এসে মিলিত হলো কলেজ মাঠে। পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখান থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে গগনবিদারী স্লোগান দিতে আমরা অগ্রসর হলাম লোকনাথ দিঘি ময়দানে।
‘যাওয়ার পথে আমাদের ফটিক ভাই সঙ্গে আরেকজনকে নিয়ে এক দৌড়ে কোর্ট ভবনে উঠে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলেন। বাঙালি জাতীয় চেতনায় শরীর শিহরিত হয়ে আবারও টগবগ করে উঠল আমাদের রক্ত। আকাশ কেঁপে উঠল আমাদের স্লোগানে—“রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, শহীদ স্মৃতি অমর হোক, নুরুল আমিনের কল্লা চাই”।
‘শহীদ বরকতের রক্তাক্ত জামার টুকরো দেখিয়ে লোকনাথ দিঘি ময়দানে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মতিউর রহমান ভাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব প্রতিষ্ঠান আর দোকানপাটে ওড়ানো হলো কালো পতাকা। সেদিনই আসন্ন স্বাধীনতার ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম এ বাঙালিকে আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনিয়ন্দ ইউনিয়নের টনকী গ্রামের মিয়া মতিন বলেন, “আমি কোনো নেতা ছিলাম না। তখন মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়তাম। ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে কয়েকজন কংগ্রেস নেতা আমাদের স্কুলে এসে ভাষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে বলে জানান। শিক্ষকরাও আমাদের এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে বলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সফল করতে আমাদের ক্লাসের পুলিন চৌধুরী এবং আমিসহ আটজনের ওপর দায়িত্ব পড়ে। এর পর থেকে শিক্ষকদের উৎসাহে সহপাঠীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য বোঝানো শুরু করি আমরা। চাটাই কেটে বানানো হয় শ দুয়েক প্ল্যাকার্ড। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যতীন্দ্র সরকার এসবের জন্য অর্থের জোগান দেন। স্কুলের করণিক বীরেন্দ্র ভট্টাচার্যসহ কয়েকজন মিলে প্ল্যাকার্ডে বিভিন্ন স্লোগান লেখেন। এর মধ্যে ছিল ‘উর্দু ভাষায় লাথি মার, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালু কর’, ‘রাষ্ট্রভাষা চাই’, ‘আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা’। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিল বের হয়। বিদ্যালয়ের ৮০০-এর মতো শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই এতে অংশ নেয়। শিক্ষক-কর্মচারীরাও যোগ দেন আন্দোলনে। আমি ছিলাম মিছিলের অগ্রভাগে। মূলত বিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন হলেও মিছিল বের হওয়ার পর এলাকার শত শত মানুষ এতে যোগ দেয়। একপর্যায়ে তা গণবিক্ষোভ কর্মসূচিতে পরিণত হয়। মিছিলটি মোগড়াবাজার, রেলওয়ে স্টেশনসহ আশপাশ এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মোগড়াবাজার এলাকায় আয়োজিত সমাবেশে আমিসহ রাজু সাহা, চনু সাহা, আবুল হাসেম, আব্দুল মালেক, অরুণ দাস প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি মানা না হলে আন্দোলন আরো বেগবান করে তোলা হবে।
মিয়া মতিন বলেন, ‘ওই দিনের কর্মসূচির পর কিভাবে কী করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছিল। এরই মধ্যে আমরা যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি, তাঁদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার। ওই সরকারের মন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার টি আলী আখাউড়ার আব্দুল মজিদ, আব্দুর রশিদ, মালেক খাদেমকে নির্দেশ দেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে থানায় জমা দিতে। তালিকা পেয়ে পুলিশ অভিযান শুরু করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আমাদের টনকীর বাড়িতে এসে পুলিশ আমার নাম ধরে কোথায় আছি জানতে চায়। পরে আমাকে পেয়ে তারা ধরে নিয়ে যায়। তবে পুলিশ আমার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। শুধু বলেছে আন্দোলন করায় সরকারের নির্দেশে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমিসহ আখাউড়ার আলী আজ্জম চৌধুরী, কসবার সুলতান খান, অহিদুজ্জামান ও অমল ঘোষকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জেলখানায় বসেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হতো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিজেশ্বরের আব্দুল মালেক, শাহবাজপুরের রবি নাগসহ আরো অনেকে আমাদের আন্দোলনের কৌশল শেখাতেন।
অ্যাডভোকেট আব্দুল বারীর সহযোগিতায় প্রায় দুই মাস পর জেল থেকে ছাড়া পান তিনি। তবে এরপর আর পড়ালেখা হয়নি। জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ডেকে নিয়ে তিনিসহ কয়েকজন ভাষাসৈনিককে শার্ট-প্যান্ট উপহার দেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইংরেজ রাজত্বকাল থেকেই অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন জনপদরূপে সমগ্র ভারত উপমহাদেশেই সুপরিচিত একটি নাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সন থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মুখর হয়ে উঠে। তার ঢেউ এসে লাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ এবং বিভিন্ন হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন সময়ে ধর্মঘট পালন করে। মিছিলে মিছিলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে।
১৯৫২ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো থানায় কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমস্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ হওয়ার কেন্দ্র ছিল কলেজ সংলগ্ন নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ। ১৯৫২ সনের ৭ ফেব্রুয়ারি মতিউর রহমানকে আহবায়ক এবং মহিউদ্দিন আহমদ ও সামিউল আহমদ খান ফটিককে যুগ্ম আহবায়ক করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কমিটির সদস্যের মধ্যে ছিলেন সগীর আহাম্মদ খান, নিজাম উদ্দিন আহাম্মদ, শফিউদ্দিন আহাম্মদ, আবিদুর রহমান, সৈয়দ মিজানুর রহমান, মুহম্মদ মুসা, শওকত হায়দার, ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, লুৎফুর রহমান প্রমুখ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয় ১৯৫২ সনের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকালেই ঢাকায় ছাত্র জনতার উপর পুলিশের গুলির খবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যোগাযোগের অভাবে ঢাকার সঠিক খবর জানা যায়নি। সঠিক খবর জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত দেড়টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মেইল আসা পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র বার্তাবাহক হয়ে নিয়ে আসে একখন্ড ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। এটি ছিল শহীদ বরকতের রক্তাক্ত শার্টের একটি টুকরো। এটি দেখে সকলেরই রক্ত টগবগ করে উঠল। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল আর মিছিলে মুখরিত ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার শাহবাজপুর গ্রামের নুরুল আমীন। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের কমন শ্লোগান ছিল “শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, নুরুল আমীনের কল্লা চাই।
১৯৫২ সনের ৫ মার্চ ছিল দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের দিন। সেই দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা সামিউল আহমেদ খান ফটিক মিছিল থেকে গ্রেফতার হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্ট বিল্ডিং হতে রাষ্ট্রীয় পতাকা নামানোর অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জেলখানা থেকেই অন্নদা হাই স্কুল পরীক্ষা কেন্দ্রে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে আসতেন পুলিশ প্রহরায় হাতে হ্যান্ডকাপ লাগানো অবস্থায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম ১৯৬২ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ সংলগ্ন স্থানে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬১-৬২ সনে কলেজের ভিপি ছিলেন মুহম্মদ মুসা। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহপাঠী আবদুল খালেককে আহবায়ক করে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি চাঁদা তুলে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করে।
পরে ১৯৭২ সনে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন কলেজের ভিপি হুমায়ুন কবির ও জিএস শেখ কুতুব হোসেনের নেতৃত্বে স্থানান্তর করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ সংলগ্ন নিয়াজ মুহাম্মদ স্কুল মাঠে দ্বিতীয়বার বড় আকারে শহীদ মিনার নির্মাণ করে। ২০০৯ সনে তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান খান মুহম্মদ মুসাকে একটি আধুনিক শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব দেন। মুহম্মদ মুসা তখন জেলা প্রশাসক আবদুল হাইকে প্রস্তাবটি জানালে তিনিও উৎসাহিত হন। শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাবটি নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমানকে জানালে তিনি খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আধুনিক শহীদ মিনার।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। অথচ যে রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার অধিকার আদায় করা হলো সেই ভাষার সঠিক চর্চা হচ্ছে না আজ। নানা বিদেশি ভাষার আগ্রাসনে বাংলা তার চরিত্র হারাচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের মতে, মাতৃভাষার সুষ্ঠু ব্যবহার এবং এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে সবাইকে। প্রয়োজনের তাগিদে ইংরেজি শিখতে হলেও তা যেন কোন অবস্থাতেই বাংলাকে দখল না করে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ভাষা সৈনিক এখনও বেঁচে আছেন তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের কেউ অসহায় অবস্থায় থাকলে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আহমদ রফিকের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে, ১৯২৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও কলাম লেখক আহমদ রফিক রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেও খ্যাতিমান। তাঁর মতে এই আন্দোলনে মূলত চারটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ছাত্রদের কেউ আন্দোলন করতে শেখায়নি। সরকারের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ছাত্ররা এই আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। তৃতীয়ত, ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত। ছাত্ররাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রাজনীতিবিদরা এর বিরোধিতা করেছিল।  চতুর্থত, পুলিশের গুলি চালানো। পুলিশের গুলি চালানোর খবর প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের যেসব উদ্দেশ্য ছিল তার মধ্যে মূল দাবি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অর্থাৎ তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু এটাই একমাত্র দাবি ছিল না। আরও কিছু দাবি ছিল, যেমন : ‘সকল রাজবন্দীর মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর’।  এই দাবিগুলোর ভিত্তিতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে এবং ষাটের দশকে এর বিকাশ ঘটে। এরই পথ বেয়ে ৬ দফা, ১১ দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এসব সংগ্রামে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল ছাত্র-যুব সমাজ। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর একুশের চেতনা অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থাৎ আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর যে সংবিধান প্রণীত হলো তা একটি ভালো সংবিধান। একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। সেখানে উল্লেখ আছে, প্রজাতন্ত্রের ভাষা হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনে তথা জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে আলোড়ন তোলা ঘটনা ছিল শহরের অদূরে পাঘাচং স্টেশনে রেললাইন অবরোধ ও ট্রেন আটক। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রহত্যার পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে পাঁচ দিন বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেনটি আটকে রাখে গ্রামের কিছু কিশোর-তরুণ। এতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ময়মনসিংহসহ পুরো উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার এমন আন্দোলনের একজন সৈনিক সদর উপজেলার চান্দপুর গ্রামের নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধও করেন তিনি। পেশাজীবনে শিক্ষকতা করে কাটিয়েছেন। তাই নাসির মাস্টার নামে বেশি পরিচিত তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পড়তেন নবম শ্রেণিতে। তিনি বলেন, আমি তখন নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলের নবম শ্রেণির  ছাত্র। তখন আমাদের স্কুলের নাম ছিল কলেজিয়েট স্কুল। পরে স্কুলের নাম হয় নিয়াজ মুহাম্মদ হাই স্কুল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল এই কলেজ। এখান থেকে বের হতো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিল। এই মিছিলের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার (তখনকার থানা) শাহবাজপুর গ্রামের নুরুল আমীন ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন। এটা মেনে নিতে পারেনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। তাই তার ওপর ক্ষোভ ছিল সবচেয়ে বেশি।
ভাষা আন্দোলনের নেতত্বে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ। স্কুলের মাঠ থেকে মিছিল বের হতো। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ‘নিয়াজ মুহাম্মদ হাই স্কুল মাঠে ব্রাহ্মণাবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা জমায়েত হতে থাকে । সকাল ১০টার মধ্যে সবাই এসে যায়। এখানে বক্তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান অলি আহমদের কথা বলেন, যিনি রেসকোর্স ময়দানে রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণার প্রতিবাদ করেছিলেন সেখানে। ধীরেন্দ্রনাথের কথাও বলেন। সভার পর বিরাট মিছিল হয়।
দুপুর পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাষা আন্দোলনে উত্তেজনা অতটুকুই ছিল। ঢাকার খবর তখনো কিছু জানা যাযনি। এরপরই পরিস্থিতি বদলে যায়। রেডিওতে খবর আসে ঢাকায় ভাষার মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, কয়েকজন ছাত্র শহীদ হয়েছেন। সঙ্গে নানা গুজব ছড়াতে থাকে। কেউ কেউ খবর দেয় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে বহু ছাত্র মারা গেছে। শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে শহরে পুলিশ, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস), আনসার নেমেছে। বেশ কয়েকজন আটক হয়েছেন। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে ছাত্রদের আটক করা হবে এমন খবর ছড়াতে থাকে।
পরিকল্পনা করা হয় স্টেশনে ট্রেন আটকানোর। কিন্তু পুলিশ-ইপিআরের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা আখাউড়ায় আটকানো সম্ভব হবে না। আমরা এলাকার ছেলেরা আজম ভাই, সাচ্চু ভাই, বাচ্চু ভাই আর পৌরসভা মেয়র মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে গ্রামে চলে আসি। আমাদের গ্রামের পাশে পাঘাচং রেলস্টেশন। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ময়মনসিংহসহ উত্তরবঙ্গের ট্রেন যোগাযোগের রেললাইন।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টায় আমরা বেশ কিছু ছেলে পাঘাচং স্টেশনে গিয়ে উত্তরবঙ্গগামী বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেন আটকাই। স্টেশন মাস্টারকেও আটকে রাখি। এ সময় আরও ছিলেন চান্দপুর গ্রামের ফুলু মাস্টার, আবদুল ওয়াহাব (পিরজি মাস্টার), জারু ভূঁইয়া, উত্তর জগৎসার গ্রামের শহীদ, পাঘাচং গ্রামের শহীদুল (পরে কাপ্টেন) আরও অনেকে। আমরা ট্রেনটি পাঁচ দিন আটকে রাখি। ওদিকে পাঘাচং স্টেশন থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চার কিলোমিটার দূরে ভাদুঘরে রেললাইন ওপড়ে ফেলেন সেখানকার ছাত্ররা। আর আখাউড়ার দিকে আমাদের গ্রাম থেকে মাইল তিনেক দূরে চিনাইর-ভাতশালায় রেললাইন ওপড়ে ফেলা হয়। দেশের প্রধান রেলপথে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় দেশজুড়ে নাড়া পড়ে তখন। রেললাইন অবরোধে পরে যোগ দেয় বিভিন্ন গ্রামের আরও মানুষ।
পুলিশ এলেও কিছু করতে পারেনি। আর তা ছাড়া স্টেশনের দুই দিকেই তিন-চার কিলোমিটার দূরে রেললাইন উপড়ানো। সম্ভবত ২৬ কিংবা ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবি মেনে নেয়ার পর ট্রেনটি ছাড়া হয়।
ভাষা আন্দোলন ঘিরে দেশের আর কোথাও এভাবে রেললাইন অবরোধের ঘটনা ঘটেছে কি না তা জানা নেই। মাতৃভাষার দাবিতে আর ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে  পাকিস্তানি শাসকদের পুলিশ আর মামলার ভয় উপেক্ষা করে তারা দেশের প্রধান রেললাইন আটকে রেখেছিল দিনের পর দিন।
তথ্যঋণ:
[১] ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম,
লেখক: মিনার মনসুর, প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ: ২০১২, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৩০,
[২] মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খন্ড)
[৩] কালের কণ্ঠ
৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
[৪] অনেক স্মৃতি অনেক কথা (১৯৯৭)।।সামিউল আহাম্মদ খান ফটিক,
[৫]  ‘ভাষা আন্দোলন : টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’।। আহমদ রফিক,প্রথমা প্রকাশন
 [৬] ঢাকা টাইমস, ২২ফেব্রুয়ারি ২০১৯
লেখক: এস এম শাহনূর 
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক