মুসলিম বিশ্বের কাছে আরবি মহরম মাস যেমন গভীর দুঃখ বেদনা ও শোকের ঠিক তেমনি ইংরেজি বছরের আগস্ট মাসও ১৭ কোটি বাঙালির হৃদয়ে বেদনার দোলা দিয়ে যায়। মহরমের আশুরার দিনের হৃদয়বিদারক ঘটনার মত বেদনাবিধুর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ট্র্যাজেডি। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড মানবেতিহাসের বর্বরোচিত ঘটনা। আমরা অনেক হত্যার কথা জানি, আমরা আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডিসহ বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কথা জানি। কিন্তু এমন নিষ্ঠুর, নির্মম, পৈশাচিক ও জঘণ্য হত্যাকাণ্ড কোথাও হয়নি। অন্ত:স্বত্তা মহিলা, শিশু রাসেল, বঙ্গমাতা কেউ বাদ যায় নি। এর চেয়ে মর্মান্তিক ও দু:খজনক ঘটনা আর কি হতে পারে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৫ খিষ্টাব্দের ৬ আগস্ট সোমবার রৌদ্র ঝলমল সকাল ৮টা ১০ মিনিটে তিনিয়ান দ্বীপের মার্কিন বিমান ঘাঁটি থেকে যুগপৎ ৩টি-বি ২৯ বোমারু বিমান সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের হিরোশিমা শহরে দুর্ধর্ষ বৈমানিক কর্নেল পল টিবেটস্ তার আনবিক বোমা বহনকারী বিমানটি থেকে নিক্ষিপ্ত ‘লিটল বয়’ নামক বোমায় প্রাণচঞ্চল শহর মৃতু্পুরীতে রূপ নেয়। মাত্র তিনদিন পর ৯ আগস্ট সকাল ১১টায় জাপানের জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহর নাগাসাকিতে বক্সার বোমারু বিমান থেকে ‘ফ্যাটম্যান’ নামক দ্বিতীয় আনবিক বোমাটি নিক্ষিপ্ত হলে প্রায় তিন লাখ মানুষের মৃতু্সহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়। এই নিরিখে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষ আগস্ট মাসে আজও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। শোকের মাস হিসেবে আগস্টের নাম বুকের বাঁপাশে চিন চিন করে। আমাদের জাতীয় জীবনেও গা শিউরে উঠা মাস আগস্ট। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ঘাতকদের হামলায় আমরা হারিয়েছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আগস্টের হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় সেই বঙ্গবন্ধু তনয়া, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আগস্ট তাই শোকের মাস, দুঃখের মাস। ১৫ থেকে ২১ আগস্ট। জানিনা ঘাতকদের নিকট এই আগস্ট কেন এত বেশি প্রিয়? জানিনা, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা নিক্ষেপকারী বিশ্বমানবতার সেই শত্রু ও জঘন্য নরপিশাচদের সতীর্থ, অনুচর কিংবা উত্তরসূরি তারা কিনা। শুধু জানি তারা আমাদের শত্রু, দেশের শত্রু,জাতির শত্রু।
আগস্টের কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু পুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিনী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।
লেখক: ড. এস এম শাহনূর
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।