ঈর্ষা একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি -আদিত্ব্য কামাল

মতামত, 5 March 2023, 125 বার পড়া হয়েছে,
ঈর্ষা ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। এই রোগের বিষক্রিয়া এতই তীব্র, দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের মধ্যে বিশাল ফাটল তৈরি করে দিতে পারে। ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে অটুট সম্পর্ক। ঈর্ষা নামক এই বিষাক্ত সাপ এতই নীরব ঘাতক, আপনার মনে এর উপস্থিতি হয়তো টেরই পাবেন না অথচ বিষে নীলে নীলাভ হয়ে যাবেন।
ঈর্ষা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু জটিল এক অনুভূতি। দুজনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে ঈর্ষার উৎপত্তি। পরের উন্নতি দেখে কাতর হওয়াই ঈর্ষা। এটা ব্যক্তিত্বের এক বিশেষ প্রকাশ। আবার পরের শ্রী দেখে ভালোলাগা বা মুগ্ধ হওয়া অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা। একইভাবে অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও দুঃখে দুঃখী হওয়া হচ্ছে কারো সঙ্গে একাত্মবোধ করা। গাছের ফুল দেখলে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু যার গাছের ফুল এত সুন্দর তার কথা ভেবে ফুলটা খারাপ লাগাই ঈর্ষা। নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকেই ঈর্ষার জন্ম। নিজের যা নেই, অন্যের আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই হিংসা, নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই ঈর্ষার উৎপত্তি। সম্পর্ক ভাঙনের আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষা।
সভ্যতার শুরু থেকে ঈর্ষার সূচনা। আদিম নারী লিলিয়াৎ ও ইভের মধ্যে ছিল ঈর্ষার চোরা স্রোত। ত্রিকোণ সম্পর্কের সেই ঈর্ষার ধারা আজো অব্যাহত আছে। সভ্যতার বর্তমান উৎকর্ষেও মানুষের যেসব আদিম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, ঈর্ষা তারই একটি। ঈর্ষার কারণে মানুষের হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। যে কারণে মানুষ ঈর্ষার যুক্তিহীন দহনে পুড়ে মরে। আবার ঈর্ষাকে অনেকে বলেন সুমহতী। ঈর্ষাই নাকি উন্নতির ইন্ধন-আরোহণ রসায়ন। তবে যে ঈর্ষা হয়ে উঠতে পারত সৃষ্টির নিয়ামক, কখনো তাই হয়ে ওঠে সর্বনাশী।
ঈর্ষা, হিংসা ও ঘৃণা মূলত মানসিক রোগ। যার উৎপত্তি প্রথমে পরিবার থেকে শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্যক্তি জীবনের সর্বত্রই সেটা ছড়িয়ে পরে। কর্মজীবনে যা প্রতিযোগিতামূলক ভাবেই ব্যাপকতা লাভ করে।
মানসিক সুস্থতা, আমরা তো সবাই শারীরিকভাবে সুস্থ কিনা এসব বিষয় নিয়ে অনেক সচেতন এবং গুরুত্বের সঙ্গে দেখি শারীরিক অসুস্থতার প্রতিটি বিষয়কে। কিন্তু মানসিক সুস্থতা আমরা কি একটিবার ও আমাদের মানসিক সুস্থতার খবর রাখি।
ঈর্ষা গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ধ্বংসাত্মক ঈর্ষার উৎস অনেক ক্ষেত্রে বাবা, মা ও সন্তানের ত্রিকোণ সম্পর্কে লক্ষ করা যায়। সন্তান যখন বাবা-মাকে পুরোপুরি নিজের করে পায় না তখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। বাবা, মা ও গুরুজনদের থেকে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেকে গঠনমূলক কাজ করে অর্থাৎ ভাবে ওই কাজটা করলে ভালোবাসা পাওয়া যাবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা ব্যাহত হলে, অন্যের ক্ষতি করাটা মনে এলে তখন তাকে ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বলা যায়।
আমাদের মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা মূলক বিষয়, অন্যের সঙ্গে তুলনা এই বিষয়গুলো অনেক বেশি মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে গিয়ে জীবনকে হারিয়ে ফেলছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সব কিছু রেখে তুলনা বা প্রতিযোগিতা কেন?
আমরা কিন্তু নিজে থেকে কেউ কারোর সঙ্গে তুলনা করি না, কাউকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয় না, এই তুলনা ভাবনা বিষয়টি আমাদের মধ্যে তৈরি করে দেয়া হয় পরিপার্শ্বিক অবস্থান থেকে। প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে সম্ভব? আমরা যদি দুটো শিশুর কথা বলি, মনে করা যাক, দুটি শিশু একজন অনেক চঞ্চল দুষ্টু আরেকজন শান্ত। দুষ্টু শিশুটি অনেক দুষ্টুমি করে অবাধ্য কথা না শুনলে তখন প্রতিবেশী, আত্মীয় বা পরিবারের লোক বা যেকোনো ব্যক্তি বলে উঠে শিশুটি বড় হয়ে ভালো মানুষ হতে পারবে না, কেন না সে দুষ্টু, তার দ্বারা কিছু সম্ভব না, মা-বাবাকে কোনো দিন সম্মান করবে না। কিন্তু একই সঙ্গে শান্ত শিশুকে উদ্দেশ্য করে তুলনা করবে, যে অন্য শিশু অনেক ভদ্র, তার মতো হতে পারেনি, অন্য বাচ্চার থেকে ভালো না অনেক খারাপ। এরকম আরও অনেক কথা। এখন যে এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করল, তিনি কি ভবিষ্যৎ থেকে ভ্রমণ করে এসে এত নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন, কে কী হবে, কার দ্বারা কী সম্ভব, কী সম্ভব নয়! এটি তো মোটেও ভালো তিনি করেননি। বরং মধ্য থেকে একটি শিশুর সঙ্গে আরেকজনের তুলনা করলেন, উদাহরণ টানলেন; ফলস্বরূপ শিশুদের মধ্যে একটি ভাবনা কাজ করবে, শিশু ভাববে, ওই তো অনেক বাজে, তার কাছে ওপর শিশুটি হীন মনে হবে। ওপর শিশুর মনেও ভাবনা আসবে, সব সময় তাকে কেন ভালো বলা হবে। এভাবে আস্তে আস্তে রেষারেষি সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে মানসিক অসুস্থতা। নোংরা প্রতিযোগিতা একজনের থেকে অন্যজনের ভালো করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ মানসিকভাবে কেউ ভালো থাকবে না। সর্বদা, একটি চিন্তা কাজ করবে, অন্যর থেকে কীভাবে ভালো করা যায়! জীবনে অশান্তি তে থাকতে এর থেকে বড় চিন্তা কি আর কিছু আছে? সব পেয়েও তখন আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না, নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট স্যাটিসফাইড নই।
আমরা কিন্তু সব সময় অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি, কখনও নিজের সঙ্গে না। অন্যের থেকে কীভাবে ভালো করা যায় এসব ভাবি কিন্তু নিজেকে কীভাবে বর্তমান আমি থেকে আরও বেশি ভালো করা যায় এসব ভাবি না। সময়ের পরিক্রমায় আমরা এই ভালো করার চেষ্টায় মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হতে থাকি।
সব ক্ষেত্রে আমরা তুলনা করতে পছন্দ করি, অন্যের থেকে নিজেকে কতটা উচ্চ আসনে রাখা যায় তার হিসাব করি, এসব করে যেন পৈশাচিক আনন্দ মেলে, তবে কি আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ? নয়তো এমন আনন্দ তো হওয়ার কথা নয়। রেজাল্ট, চাকরি, পড়াশোনা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বলি, অমুক এই কাজটি করেছে আমিও করব। আমরা কেন নিজেকে অন্যভাবে ভাবতে পারি না? গতানুগতিকভাবে নিজেদের পরিচালিত করি? না কি আমাদের কে পরিচালিত করা হয়? কথাটি যদিও ভুল বলা যায় না। কারণ আমাদের আত্মীয়স্বজনসহ কিছু শুভাকাক্সক্ষী ব্যক্তি বর্গ এমন কাজটিই করে থাকেন। আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারল, আপনার ছেলে কেন পারল না? সবাই যদি ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে কি চলবে? ব্যক্তি পছন্দ, ভাগ্য, পরিশ্রম, অভিরুচি নামক শব্দগুলো কেন জানি আমরা এসব ক্ষেত্রে ভুলে যায়। শিক্ষা-পরবর্তী জীবন যে খুব সুখকর তুলনা ছাড়া এমন কিন্তু নয়, সেখানেও চাকরির পজিশন, কে কী করছে কোথায় আছে, তাদের ছেলেমেয়েকে কেমন ভালো, কার থেকে কার ছেলেমেয়ে বেশি ভালো, এসব ভেবে ভেবে সেখানেও আবার সেই প্রতিযোগিতার সূচনা ঘটানোর কাজ চলতে থাকে।
যেখানে হিংসা বা অন্যের কোনো কিছু দেখে নিজের না পাওয়া নিয়ে আফসোস করা। এসব কি আদৌ যুক্তিযুক্ত কোনো কাজ! আমরা কেন নিজেদের নিয়ে নিজেদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে খুশি থাকতে পারি না? না কি আমরা খুশি থাকতে চায় না? এসব ভাবনা হতাশাতে কি কোনো সমাধান রয়েছে? শুধুই তো নিজেদের মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি করা।
এরপরে যখন আমরা অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে করতে ক্লান্ত, তখন আমরা ভাবি আমাদের দিয়ে কিছু হবে না, জীবন বৃথা। অথবা আরেকটি বিষয় উঠে আসে তা হলো আমি কী করব? আমার কী করা উচিৎ? আমার সঙ্গে আগে কী ঘটেছে এখন কী ঘটছে? এসব ভাবতে ভাবতে আমরা বর্তমানকে নষ্ট করছি। যতটা সময় ধরে আমরা এই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলিয়ে যাচ্ছি ততটা সময় পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে আগামী ভালো করতে পারি। কিন্তু না আমরা তো করব না। আমাদের তো পুরোনো সবকিছু ভেবে মানসিক চাপ নিতে অনেক বেশি ভালো লাগে। আমাদের তো ইচ্ছে শক্তি আমরা নিজেরাই দমন করছি। এখানে অন্য কোনো সহায়কের প্রয়োগ ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। আমরা নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে লক্ষ্য থেকে সরে আসি; যা করা আমাদের উচিত নয়। এজন্য হয়তো চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, কোনো লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব মনে হলেও লক্ষ্য বদল করবে না, বরং কৌশল বদলে ফেলো” কিন্তু আমরা নিজেদের বদলে ফেলে হতাশায় নিমজ্জিত হই। আমাদের উচিত নিজেকে বিশ্বাস করা, নিজের কাজের ওপর আত্মবিশ্বাসী হওয়া।
কেউ বলেন ঈর্ষা জিনঘটিত, কিছু অর্জন করার জন্য মানুষের মনে ঈর্ষা আসে। কিন্তু এ নিয়ে বিজ্ঞান এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। ঠিক কেমন করে কাজ করে মানুষের প্রবণতার পরম্পরা, তাও অনাবিষকৃত। ঈর্ষা ও জিনের সম্পর্ক যদি কখনো থাকেও, কোন প্রজন্মে তার প্রকাশ ঘটবে, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এর প্রকাশ নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। সত্যিকার অর্থে জিনের প্রকাশ এক প্রজন্মে হয় না। শারীরিক উপাদান ও পরিবেশের নানা উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে মানুষের একেকটা গুণ বা দোষের প্রকাশ ঘটে। অনেক সময় ঈর্ষা থেকে তুলনা ও অনুকরণ আসে। কিন্তু এগুলো ঠিকমতো করতে না পারলে ঈর্ষার জন্ম হয়। মূলত অভাববোধ থেকেই মানুষের মনে ঈর্ষার জন্ম হয়। এ অভাববোধ যে কোনো প্রকারের হতে পারে। এটা ঠিক পার্থিব বস্তুর অভাব নয়, সুখের অভাব। মনে মনে সুখী হওয়াটা বড় কথা। আমাদের প্রত্যেকের আমিত্বের একটা গণ্ডি বা সীমানা আছে। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, বাড়ি-গাড়ি, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমাদের জগৎ। এ আমিত্বের গণ্ডি যে ব্যক্তির যত সীমিত ততই তার মধ্যে নিরাপত্তার অভাব। এ অভাববোধ আমাদের মধ্যে অসম্পূর্ণতা নিয়ে আসে, যা ঈর্ষার জন্ম দেয়।
বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালচিত্রে দুটি জিনিস চোখে পড়ার মতো। প্রথমত, সাফল্যের প্রতি মানুষের একমুখী ধাববান গতি এবং দ্বিতীয়ত, মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতামূলক বিরোধের সম্পর্ক। ধরেই নেয়া হয়, কোনো কাজে সাফল্যই একমাত্র লক্ষ্য আর সফলতা লাভে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে দরকার প্রতিযোগিতার মানসিকতা। এ অবস্থায় মানুষ তার ব্যবহারে হয়ে পড়ে যান্ত্রিক, দেখা দেয় পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা। ফলে নিরন্তর মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয় এবং মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তাড়াতাড়ি ছন্দ হারায়। আজকের হাইটেক যত উন্নতির পথে এগোবে, মানুষ ততই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠার এ প্রবণতাকে সত্যিকার অর্থে ত্বরান্বিত করে ঈর্ষা।
অর্থ, বিত্ত ও যৌনসংক্রান্ত বিষয় থেকেই যাবতীয় ঈর্ষার উৎপত্তি। এছাড়া ক্ষুধা থেকেও ঈর্ষা আসে। আজকের সমাজে যে এত হানাহানি ও সংঘাত বেড়ে উঠছে তার মূলে রয়েছে সত্যিকার অর্থে ঈর্ষা। সাধারণত ঈর্ষার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকে না। ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি মিথ্যা বিশ্বাসে ভুগতে থাকেন যে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ঠকাচ্ছে, সে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িত।
জীবনে সবকিছু নিজের চাহিদামতো পাওয়া যায় না। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কমিউনিকেশন ক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করতে হবে। মানসিক ও আবেগগত দিক থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে চেষ্টা করতে হবে। নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অভাব বুঝতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। অন্যের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঈর্ষান্বিত হওয়ায় লজ্জার কিছু নেই। ঈর্ষা না থাকা মহান কোনো ব্যাপার নয়। একা না থেকে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। অন্যের সঙ্গে আপনার ভাবনা ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সুখ-সমৃদ্ধির উপাদান সবাই অর্জন করতে চায়। যেমন মধ্যবিত্তের তিন ভাগ-উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন। এদের মধ্যে সব সময় লড়াই চলতে থাকে। এই ‘ক্লাস শিফটিং’ কীভাবে হয় তা যদি লক্ষ করা যায় তবে দেখা যাবে হিংসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তরণের সপৃহাকে বাড়িয়ে দেয়। চাহিদা অবাস্তব হলেই ঈর্ষা বেশি মানসিক ক্ষতি করে। ব্যর্থতা ও অসমতা মেনে নিতে না পেরেও কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হন। যেসব মানুষ সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না তারাও ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকে আসে মানুষের অসামাজিক আচার-আচরণ। বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেলার আপাতত তুচ্ছ ঘটনাও যার মধ্যে পড়ে। সমাজের মূল স্রোত থেকে যারাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের মধ্যেই এ প্রবণতা প্রবল। কারণ এ ক্ষেত্রে মমত্ববোধ কাজ করে না। বাণ মারা, তুক-তাক করাও ঈর্ষার সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রকাশ। সমাজে ইচ্ছা ও ক্ষমতা একসঙ্গে এসেছে। ঈর্ষা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই উপাদানেই তৈরি। আমরা কতটা স্বাভাবিক ও সুস্থ আছি, অর্থাৎ সুস্থতার মানসিক বোধ  নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। ঈর্ষানুভূতি অনেক ক্ষেত্রে এ পারসপরিক সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আসে। আর তখনই হয় ক্ষতির সূচনা। মাত্রাহীন পরশ্রীকাতরতায় মানুষের বাস্তববোধ কাজ করে না। ঈর্ষা হলো গ্রিন আইভ মনস্টার। এ সবুজ চোখের দানব খুবই শক্তিশালী। এর দানবীয় শক্তি মোকাবেলায় চাই অন্তরের সুপ্ত মানবিক বোধের বিকাশ। ঈর্ষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করাটা নিজের দায়িত্ব। বল্গাহীন সমাজে যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে, তারা পিছিয়ে পড়ছে। এরাই ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি। নিজের বোধ, বিবেচনা, বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এর জন্য নিজেকে পরিশীলিত ও বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। মূল কথা হচ্ছে বোধ ও বিবেচনা দিয়ে যে কোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করলে মনে ঈর্ষার কোনো জায়গা হতে পারে না।
ঈর্ষাজনিত যে দহন ও উৎকণ্ঠা তাতে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ক্রমাগত ক্ষয় হয়। ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে আমরা কর্মক্ষেত্রে যে শক্তি নিয়োগ করি তার অনেকটারই অপচয় হয় এ দহনজ্বালায়। এ শক্তিকে বেশি ক্ষয় না করে যদি কাজে নিয়োগ করা যায়, উৎপাদন শক্তিও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কারণ তখন প্রেরণা আসে অন্তরের সম্ভাবনাময় শক্তিপুঞ্জের জাগরণ থেকে, সতীর্থ কিংবা সহকর্মীর সাফল্যজনিত ঈর্ষার অন্তর্দহন থেকে নয়। কর্মের প্রকৃত লক্ষ্য সাফল্য বা উৎকর্ষতাকে যদি লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তখনই সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রতি সমভাব বজায় রাখা যায়। তখন প্রতিযোগী আর বাইরের কোনো সফল সতীর্থ বা সহকর্মী নয়, অতীতের আমিই তখন বর্তমান আমির প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যের প্রতি যদি সাময়িকভাবে ঈর্ষার ভাব আমাদের মনে জেগে ওঠে, আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের গভীরে ডুব দিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারি।
মূলত হেরে যাওয়ার ভয় থেকে ঈর্ষার জন্ম। আর পাঁচটা অনুভূতি বা আবেগের মতো ঈর্ষাও একটি মানসিক অবস্থা। তার বাহ্যিক প্রকাশ একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। যে ব্যক্তি ঈর্ষা করে তার মধ্যে একটা হীনমমন্যতা কাজ করে। যাকে সে ঈর্ষা করছে তার মতো হতে না পারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, গুরুত্ব না পাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যের চোখে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিকে কীভাবে ছোট করা যায় তার নিরন্তর প্রচেষ্টাই এ হীনমমন্যতার জন্ম দেয়। ঈর্ষার নিজস্ব ডাইমেনশন রয়েছে। কেউ ভালো নাম্বার পেলে কম নাম্বার পাওয়া মানুষটি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এটা ঈর্ষার নেতিবাচক দিক। কিন্তু যখন মানুষটি ভাবেন ওই নাম্বার তাকেও পেতে হবে তখন ঈর্ষা ইতিবাচক। ক্ষমতার পায়ে পায়ে ঈর্ষার চলাফেরা। যে ক্ষমতার জন্য মানুষ অবিরাম সন্দেহ আর অবিশ্বাস, ভ্রমবাতুলতার মনোরোগ হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই রাজা-বাদশাদের যুগে প্রচুর গুপ্তহত্যার ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঈর্ষার আরেকটি কারণ। তবে মুখ্য হলো ব্যক্তিগত হিংসা। নিজেকে মহান ভাবার বোধ, যাকে বলা হয় অস্বাভাবিক অহংমন্যতা, এর থেকেও আবার তৈরি হয় কূপমণ্ডুতা। এর উৎস নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা। তবে দুটি সমমেধা যদি একে অন্যের পরিপূরক হয় তবে তা গঠনমূলক, সেখানে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষা নেই। কিন্তু এর মধ্যে আমিত্ব বড় হয়ে উঠলেই ঈর্ষার উদয় হয়। তবে সব ক্ষেত্রে তা হয় না, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সমানে সমানে। তাছাড়া সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাস্থ্যকর দিকও রয়েছে।
সব মানুষ কি ঈর্ষাপরায়ণ না, যে মানুষ যথাযথ আত্মসমীক্ষা, আত্মবিশ্লেষণ করতে পারেন তাদের ঈর্ষা কম হয়। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা আসে না। মনের প্রসারতা বাড়ালে ঈর্ষা কমে। সন্ন্যাসীর ঈর্ষা থাকে না। বিশেষণে কোনো একটা জায়গায় নিজেকে কম মনে হলে ঈর্ষা জন্মায়। ঈর্ষার পেছনে বুদ্ধি কাজ করে। মানসিক প্রতিবন্ধীদের তাই কোনো ঈর্ষা থাকে না।
ছোটবেলায় মনে হতো আমার থেকে শিপনকেই সবাই ভালোবাসত। ছোটবেলায় ভাইয়া যা চাইত তাই পেত; কিন্তু আমি পেতাম না। বন্ধুর স্কুলব্যাগটা অনেক সুন্দর। তা দেখে আমার মন খারাপ হতো। আমি বিশ্বাস করি, খুব বেশি পয়সা থাকলে মানসিক শান্তি থাকে না, তার চেয়ে পয়সা কম থাকাই ভালো। আমার থেকে সহকর্মীর ওপর অফিশিয়াল ব্যাপারে বেশি নির্ভর করা হয়। বন্ধুর দামি মোবাইল দেখে আমার খুব রাগ হয়। আমার সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে কারণ যে মেয়েটিকে আমার ভালো লাগত তার সঙ্গে আমার বন্ধুর বিয়ে হয়েছে। বলা যায় ঈর্ষার সঙ্গে মানুষের কল্পনা কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে যায়।
ঈর্ষা সুযোগসাপেক্ষ। ঈর্ষার সঙ্গে এক ধরনের লজ্জাবোধ থাকে, যার ফলে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি নিজেকেও ছোট মনে করেন। অন্যদিকে হিংসার মধ্যে একটা আক্রমণাত্মক ভাব থাকে এবং হিংসা বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঈর্ষা মানুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে না, হিংসার ক্ষেত্রে তা সম্ভব। সম্পর্কের নৈকট্য ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক গঠনের ওপর। প্রতিটি ব্যক্তিসত্তা আলাদা, বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপের মতো, আলাদা চাহিদা যা সম্পর্ক-নিরপেক্ষ, সেখানে যখন আঘাত লাগে তখনই ঈর্ষার উদয় হয়। যে ব্যক্তি সব সময় নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় দেখতে চান তার ঈর্ষা বেশি। ঈর্ষা সম্পর্কের ক্ষতি করে। যেমন-স্ত্রীর সাফল্যে স্বামীর প্রাথমিক ভালোলাগা থাকলেও যে কোনো জমায়েত, অফিস পার্টি, পারিবারিক অনুষ্ঠানে ক্রমাগত স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে শুনতে স্বামীর মধ্যে হীনমমন্যতা তৈরি হয়, স্বামী ঈর্ষান্বিত বোধ করেন, সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ঠিক বিপরীত দিকে সফল স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর ঈর্ষা জন্ম নিতে পারে। ইচ্ছা আর হিংসা এ দুইকে এক চোখে দেখতে চান না মনস্তাত্ত্বিকদের একাংশ। আর সেখানেই ঈর্ষা হয়ে ওঠে আরোহণের ময়ূরকণ্ঠী লিপ্সা।
প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি সম্পর্কের বিশেষণে দেখা যায় ভালোবাসা হারানোর ভয়; মনোযোগ হারানোর ভয় উভয়কেই তাড়া করে ফেরে। স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হলে স্ত্রীর প্রথম যে প্রতিক্রিয়া সেটাই ঈর্ষা। সম্পর্কের মূল্য হারানোর দুঃখবোধ তাদের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। স্বজন হারানোর দুঃখের থেকেও এ ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে ওঠে এক নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণা। আমার যা ছিল তা অন্যের হয়ে যাচ্ছে-এ অনুভূতি বা অসহায়তা থেকেই ইমোশনাল বা আবেগজনিত জটিলতা তৈরি হয়। ঈর্ষা দুই রকম-স্বাভাবিক ঈর্ষা, অস্বাভাবিক ঈর্ষা। অস্বাভাবিক ঈর্ষা মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ঈর্ষার প্রকৃত কোনো কারণ নেই। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সৌন্দর্য সম্পর্কে সবার প্রশংসায় হীনমমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। সন্দেহ শুরু হয় স্ত্রী যদি অন্যের হয়ে যান, এ হারানোর ভয় থেকে। যার ফলে অসময়ে অফিস থেকে এসে টেবিলে দুটি চায়ের কাপ দেখে ঈর্ষায় জ্বলতে থাকেন।
সম্পর্ক গড়ার প্রথমদিকে নতুন দম্পতিদের মধ্যে ভালোবাসা থেকে ঈর্ষার মনোভাব দেখা যায়। নিজের আচরণের বিপরীতে সঙ্গীর মধ্যে কোনো রকম ঈর্ষার প্রকাশ না দেখে ধরে নেন তার সঙ্গী তাকে ভালোবাসে না। দখলদারিত্বের বিভিন্ন ধারণা থেকেই এ সমস্যার উৎপত্তি হয়। আসলে সম্পর্কের নিবিড়তায় যারা তৃপ্ত তাদের মধ্যে এ ধরনের ঈর্ষার জন্ম হয় না।
ঈর্ষা সেসব মানুষের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে, যাদের মানসিক গঠন শক্তিশালী এবং ভারসাম্য আছে। এমন মানুষকে ঈর্ষা মোটিভেট বা উদ্বুদ্ধ করে। ঈর্ষা যখন চরম আকার নেয়, হিংসার রূপ ধরে, তখনই মানসিক সমস্যা শুরু হয়। এ সময়ে মানুষ নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়, ডিপ্রেশনে ভোগে, কখনো আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সব ব্যক্তিকে ক্ষতিকারক মনে করে। ক্ষতির জন্য ক্ষতি করা আর ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষতি করা কিন্তু এক নয়। দুটি ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়। তাই ঈর্ষাকে চেনা জরুরি। জানা দরকার, ঈর্ষা নামের এ বহুরূপীর নানা মুখ ও মুখোশ। সে সঙ্গে জানা দরকার নিজের মনের আঁধার গহীনের সাদা-কালো ছবি। পড়ুন-চিনুন নিজেকে, অচেনা ‘আমি’ কে?
ঈর্ষা ভালোবাসার উল্টো। ছেলেরা সঙ্গী হারানোর আশঙ্কায় ভোগে, মেয়েরা সম্পর্কের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে। ছেলেরা ঈর্ষাবোধকে প্রকাশ করতে চায় না, তারা তাদের হীনমমন্যতাবোধ স্বীকার করতে চায় না। মেয়েরা অনুভূতি প্রকাশ করে নিজেদের আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। তীব্র আত্মসমমানবোধ আছে এমন মেয়েরা ঈর্ষান্বিত হন না। আত্মসমমানবোধ যাদের কম, আত্মবিশ্বাসের অভাবে যারা ভোগেন তারা ঈর্ষান্বিত বেশি হন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা উঠে এসেছে ঈর্ষা, হিংসা ও ঘৃণা মানুষকে নানা ভাবে অশান্ত করে তোলে, কুড়ে কুড়ে খায়, স্ট্রেস তৈরি করে। এক কথায় এগুলো মানুষকে ভয়াবহ অসুস্থ করে তোলে। আমরা এখন অন্যের সুখ দেখে হিংসায় অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই অন্যকে অশান্তিতে ফেলতে না পারলে নিজেরা শান্তি পাই না। অন্যকে কষ্ট দিয়েই এক ধরণের শান্তি আমরা লাভ করি। অন্যের ঘরে হট্টগোল লাগিয়ে নিজের ঘরে শান্তি চাই। এটি এক ধরণের শান্তি। আবার মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে, অবহেলা করে মানুষের বে-ইজ্জুত করে, মানুষের সম্পদ লুটপাট করে এক ধরণের শান্তি পেতে চাই। আসলে ঈর্ষা এত মারত্মক একটি দোষ যার সূক্ষ্ম উপস্থিতিও অনেক বড় ক্ষতি সাধন করতে পারে। ঈর্ষা, হিংসা এবং ঘৃণা মানুষের অত্মবিশ্বাস নষ্ট করে, আত্মসম্মান বোধকে ধ্বংস করে, জীবনের আনন্দকে মাটি করে দিতে পারে। সম্পর্ক নষ্ট করা থেকে শুরু করে জটিল রোগ সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই আপনি ইতিবাচক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেন।
ঈর্ষা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু জটিল এক অনুভূতি। দুজনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে ঈর্ষার উৎপত্তি। পরের উন্নতি দেখে কাতর হওয়াই ঈর্ষা। এটা ব্যক্তিত্বের এক বিশেষ প্রকাশ। আবার পরের শ্রী দেখে ভালোলাগা বা মুগ্ধ হওয়া অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা। একইভাবে অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও দুঃখে দুঃখী হওয়া হচ্ছে কারো সঙ্গে একাত্মবোধ করা। গাছের ফুল দেখলে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু যার গাছের ফুল এত সুন্দর তার কথা ভেবে ফুলটা খারাপ লাগাই ঈর্ষা। নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকেই ঈর্ষার জন্ম। নিজের যা নেই, অন্যের আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই হিংসা, নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই ঈর্ষার উৎপত্তি। সম্পর্ক ভাঙনের আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষা।
ঈর্ষা গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ধ্বংসাত্মক ঈর্ষার উৎস অনেক ক্ষেত্রে বাবা, মা ও সন্তানের ত্রিকোণ সম্পর্কে লক্ষ করা যায়। সন্তান যখন বাবা-মাকে পুরোপুরি নিজের করে পায় না তখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। বাবা, মা ও গুরুজনদের থেকে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেকে গঠনমূলক কাজ করে অর্থাৎ ভাবে ওই কাজটা করলে ভালোবাসা পাওয়া যাবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা ব্যাহত হলে, অন্যের ক্ষতি করাটা মনে এলে তখন তাকে ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বলা যায়।
সাধারণত এ ধরনের ঈর্ষার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকে না। ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি মিথ্যা বিশ্বাসে ভুগতে থাকেন যে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ঠকাচ্ছে, সে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িত। জীবনে সবকিছু নিজের চাহিদামতো পাওয়া যায় না। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কমিউনিকেশন ক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করতে হবে।
মানসিক ও আবেগগত দিক থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে চেষ্টা করতে হবে। নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অভাব বুঝতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। অন্যের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঈর্ষান্বিত হওয়ায় লজ্জার কিছু নেই। ঈর্ষা না থাকা মহান কোনো ব্যাপার নয়। একা না থেকে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। অন্যের সঙ্গে আপনার ভাবনা ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সুখ-সমৃদ্ধির উপাদান সবাই অর্জন করতে চায়। যেমন মধ্যবিত্তের তিন ভাগ-উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন। এদের মধ্যে সব সময় লড়াই চলতে থাকে। এই ‘ক্লাস শিফটিং’ কীভাবে হয় তা যদি লক্ষ করা যায় তবে দেখা যাবে হিংসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তরণের সপৃহাকে বাড়িয়ে দেয়। চাহিদা অবাস্তব হলেই ঈর্ষা বেশি মানসিক ক্ষতি করে। ব্যর্থতা ও অসমতা মেনে নিতে না পেরেও কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হন। যেসব মানুষ সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না তারাও ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকে আসে মানুষের অসামাজিক আচার-আচরণ। বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেলার আপাতত তুচ্ছ ঘটনাও যার মধ্যে পড়ে। সমাজের মূল স্রোত থেকে যারাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের মধ্যেই এ প্রবণতা প্রবল। কারণ এ ক্ষেত্রে মমত্ববোধ কাজ করে না। বাণ মারা, তুক-তাক করাও ঈর্ষার সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রকাশ। সমাজে ইচ্ছা ও ক্ষমতা একসঙ্গে এসেছে। ঈর্ষা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই উপাদানেই তৈরি। আমরা কতটা স্বাভাবিক ও সুস্থ আছি, অর্থাৎ সুস্থতার মানসিক বোধ নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। ঈর্ষানুভূতি অনেক ক্ষেত্রে এ পারসপরিক সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আসে। আর তখনই হয় ক্ষতির সূচনা। মাত্রাহীন পরশ্রীকাতরতায় মানুষের বাস্তববোধ কাজ করে না।
ঈর্ষা হলো গ্রিন আইভ মনস্টার। এ সবুজ চোখের দানব খুবই শক্তিশালী। এর দানবীয় শক্তি মোকাবেলায় চাই অন্তরের সুপ্ত মানবিক বোধের বিকাশ। ঈর্ষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করাটা নিজের দায়িত্ব। বল্গাহীন সমাজে যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে, তারা পিছিয়ে পড়ছে। এরাই ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি। নিজের বোধ, বিবেচনা, বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এর জন্য নিজেকে পরিশীলিত ও বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। মূল কথা হচ্ছে বোধ ও বিবেচনা দিয়ে যে কোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করলে মনে ঈর্ষার কোনো জায়গা হতে পারে না।
ঈর্ষাজনিত যে দহন ও উৎকণ্ঠা তাতে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ক্রমাগত ক্ষয় হয়। ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে আমরা কর্মক্ষেত্রে যে শক্তি নিয়োগ করি তার অনেকটারই অপচয় হয় এ দহনজ্বালায়। এ শক্তিকে বেশি ক্ষয় না করে যদি কাজে নিয়োগ করা যায়, উৎপাদন শক্তিও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কারণ তখন প্রেরণা আসে অন্তরের সম্ভাবনাময় শক্তিপুঞ্জের জাগরণ থেকে, সতীর্থ কিংবা সহকর্মীর সাফল্যজনিত ঈর্ষার অন্তর্দহন থেকে নয়। কর্মের প্রকৃত লক্ষ্য সাফল্য বা উৎকর্ষতাকে যদি লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তখনই সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রতি সমভাব বজায় রাখা যায়। তখন প্রতিযোগী আর বাইরের কোনো সফল সতীর্থ বা সহকর্মী নয়, অতীতের আমিই তখন বর্তমান আমির প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যের প্রতি যদি সাময়িকভাবে ঈর্ষার ভাব আমাদের মনে জেগে ওঠে, আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের গভীরে ডুব দিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারি।
মূলত হেরে যাওয়ার ভয় থেকে ঈর্ষার জন্ম। আর পাঁচটা অনুভূতি বা আবেগের মতো ঈর্ষাও একটি মানসিক অবস্থা। তার বাহ্যিক প্রকাশ একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। যে ব্যক্তি ঈর্ষা করে তার মধ্যে একটা হীনমমন্যতা কাজ করে। যাকে সে ঈর্ষা করছে তার মতো হতে না পারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, গুরুত্ব না পাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যের চোখে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিকে কীভাবে ছোট করা যায় তার নিরন্তর প্রচেষ্টাই এ হীনমমন্যতার জন্ম দেয়। ঈর্ষার নিজস্ব ডাইমেনশন রয়েছে। কেউ ভালো নাম্বার পেলে কম নাম্বার পাওয়া মানুষটি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এটা ঈর্ষার নেতিবাচক দিক। কিন্তু যখন মানুষটি ভাবেন ওই নাম্বার তাকেও পেতে হবে তখন ঈর্ষা ইতিবাচক। ক্ষমতার পায়ে পায়ে ঈর্ষার চলাফেরা। যে ক্ষমতার জন্য মানুষ অবিরাম সন্দেহ আর অবিশ্বাস, ভ্রমবাতুলতার মনোরোগ হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই রাজা-বাদশাদের যুগে প্রচুর গুপ্তহত্যার ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঈর্ষার আরেকটি কারণ। তবে মুখ্য হলো ব্যক্তিগত হিংসা। নিজেকে মহান ভাবার বোধ, যাকে বলা হয় অস্বাভাবিক অহংমন্যতা, এর থেকেও আবার তৈরি হয় কূপমণ্ডুতা। এর উৎস নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা। তবে দুটি সমমেধা যদি একে অন্যের পরিপূরক হয় তবে তা গঠনমূলক, সেখানে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষা নেই। কিন্তু এর মধ্যে আমিত্ব বড় হয়ে উঠলেই ঈর্ষার উদয় হয়। তবে সব ক্ষেত্রে তা হয় না, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সমানে সমানে। তাছাড়া সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাস্থ্যকর দিকও রয়েছে।
সব মানুষ কি ঈর্ষাপরায়ণ না, যে মানুষ যথাযথ আত্মসমীক্ষা, আত্মবিশ্লেষণ করতে পারেন তাদের ঈর্ষা কম হয়। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা আসে না। মনের প্রসারতা বাড়ালে ঈর্ষা কমে। সন্ন্যাসীর ঈর্ষা থাকে না। বিশেষণে কোনো একটা জায়গায় নিজেকে কম মনে হলে ঈর্ষা জন্মায়। ঈর্ষার পেছনে বুদ্ধি কাজ করে। মানসিক প্রতিবন্ধীদের তাই কোনো ঈর্ষা থাকে না।
ঈর্ষা সুযোগসাপেক্ষ। ঈর্ষার সঙ্গে এক ধরনের লজ্জাবোধ থাকে, যার ফলে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি নিজেকেও ছোট মনে করেন। অন্যদিকে হিংসার মধ্যে একটা আক্রমণাত্মক ভাব থাকে এবং হিংসা বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঈর্ষা মানুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে না, হিংসার ক্ষেত্রে তা সম্ভব। সম্পর্কের নৈকট্য ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক গঠনের ওপর। প্রতিটি ব্যক্তিসত্তা আলাদা, বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপের মতো, আলাদা চাহিদা যা সম্পর্ক-নিরপেক্ষ, সেখানে যখন আঘাত লাগে তখনই ঈর্ষার উদয় হয়। যে ব্যক্তি সব সময় নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় দেখতে চান তার ঈর্ষা বেশি। ঈর্ষা সম্পর্কের ক্ষতি করে। যেমন-স্ত্রীর সাফল্যে স্বামীর প্রাথমিক ভালোলাগা থাকলেও যে কোনো জমায়েত, অফিস পার্টি, পারিবারিক অনুষ্ঠানে ক্রমাগত স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে শুনতে স্বামীর মধ্যে হীনমমন্যতা তৈরি হয়, স্বামী ঈর্ষান্বিত বোধ করেন, সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ঠিক বিপরীত দিকে সফল স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর ঈর্ষা জন্ম নিতে পারে। ইচ্ছা আর হিংসা এ দুইকে এক চোখে দেখতে চান না মনস্তাত্ত্বিকদের একাংশ। আর সেখানেই ঈর্ষা হয়ে ওঠে আরোহণের ময়ূরকণ্ঠী লিপ্সা।
ঈর্ষার দুটি মৌলিক তত্ত্ব ইভুলিউশনারি থিয়রি অব সোশ্যাল কন্সট্রাক্ট থিওরি। বিবর্তনবাদ মতে, জেলাসি পারফর্মস অ্যান অ্যাকশন ইদ দি প্রিজার্ভেশন অব দি সিপশিস। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের সেক্সুয়াল ইনফিডেলটিতে বা অবিশ্বস্ত যৌন সম্পর্কের কারণে বেশি ঈর্ষান্বিত হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। মেয়েরা ছেলেদের ইমোশনাল ইনফিডেলটি বা আবেগজনিত অসততায় ভয় পান এবং ঈর্ষাবোধ করেন। তাদের যুক্তি হলো, যখন ছেলেরা মানসিকভাবে বিশ্বস্ত থাকে তখন তারা অন্য কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও তা হয় সাময়িক। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি সম্পর্কের বিশেষণে দেখা যায় ভালোবাসা হারানোর ভয়; মনোযোগ হারানোর ভয় উভয়কেই তাড়া করে ফেরে। স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হলে স্ত্রীর প্রথম যে প্রতিক্রিয়া সেটাই ঈর্ষা। সম্পর্কের মূল্য হারানোর দুঃখবোধ তাদের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। স্বজন হারানোর দুঃখের থেকেও এ ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে ওঠে এক নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণা। আমার যা ছিল তা অন্যের হয়ে যাচ্ছে-এ অনুভূতি বা অসহায়তা থেকেই ইমোশনাল বা আবেগজনিত জটিলতা তৈরি হয়। ঈর্ষা দুই রকম-স্বাভাবিক ঈর্ষা, অস্বাভাবিক ঈর্ষা। অস্বাভাবিক ঈর্ষা মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ঈর্ষার প্রকৃত কোনো কারণ নেই। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সৌন্দর্য সম্পর্কে সবার প্রশংসায় হীনমমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। সন্দেহ শুরু হয় স্ত্রী যদি অন্যের হয়ে যান, এ হারানোর ভয় থেকে। যার ফলে অসময়ে অফিস থেকে এসে টেবিলে দুটি চায়ের কাপ দেখে ঈর্ষায় জ্বলতে থাকেন। ঈর্ষান্বিত হয়ে স্ত্রীর সঙ্গে অতিরিক্ত যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে শুরু করেন। স্ত্রী রাজি না হলে স্বামী মনে করেন, স্ত্রী অবশ্যই পরপুরুষের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। তবে ঈর্ষা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলেই মানুষ এমন অপ্রকৃতিস্থ আচরণ করতে শুরু করে। সাধারণত আমাদের অন্তর্জগতে দুই রকম বৃত্তি কাজ করে-বুদ্ধিবৃত্তি (ইন্টেলিজেন্স) ও হৃদয়বৃত্তি (ইমোশন)। ঈর্ষার উৎস দ্বিতীয় বৃত্তি থেকে।
সম্পর্ক গড়ার প্রথমদিকে নতুন দম্পতিদের মধ্যে ভালোবাসা থেকে ঈর্ষার মনোভাব দেখা যায়। নিজের আচরণের বিপরীতে সঙ্গীর মধ্যে কোনো রকম ঈর্ষার প্রকাশ না দেখে ধরে নেন তার সঙ্গী তাকে ভালোবাসে না। দখলদারিত্বের বিভিন্ন ধারণা থেকেই এ সমস্যার উৎপত্তি হয়। অনেক সময় এমনো দেখা যায়, পুরুষ সঙ্গীর ভালোবাসা পরীক্ষা করার জন্য মেয়ে পার্টনার নানাভাবে ফ্ল্যাট (ফলমড়য়) করতে শুরু করেন। আসলে সম্পর্কের নিবিড়তায় যারা তৃপ্ত তাদের মধ্যে এ ধরনের ঈর্ষার জন্ম হয় না।
ঈর্ষা সেসব মানুষের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে, যাদের মানসিক গঠন শক্তিশালী এবং ভারসাম্য আছে। এমন মানুষকে ঈর্ষা মোটিভেট বা উদ্বুদ্ধ করে। ঈর্ষা যখন চরম আকার নেয়, হিংসার রূপ ধরে, তখনই মানসিক সমস্যা শুরু হয়। এ সময়ে মানুষ নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়, ডিপ্রেশনে ভোগে, কখনো আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সব ব্যক্তিকে ক্ষতিকারক মনে করে। ক্ষতির জন্য ক্ষতি করা আর ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষতি করা কিন্তু এক নয়। দুটি ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়। তাই ঈর্ষাকে চেনা জরুরি। জানা দরকার, ঈর্ষা নামের এ বহুরূপীর নানা মুখ ও মুখোশ। সে সঙ্গে জানা দরকার নিজের মনের আঁধার গহীনের সাদা-কালো ছবি।
একজনের বেশি কাউকে ভালোবাসা অসম্ভব। সম্পর্কে অমীমাংসিত নিরাপত্তার অভাব। বিশ্বাসের সমস্যা। সঙ্গীর স্বীকার করার সৎ সাহসের প্রতি অনাস্থা। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অনীহা। ঈর্ষা ভালোবাসার উল্টো ছেলেরা সঙ্গী হারানোর আশঙ্কায় ভোগে, মেয়েরা সম্পর্কের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে। ছেলেরা ঈর্ষাবোধকে প্রকাশ করতে চায় না, তারা তাদের হীনমমন্যতাবোধ স্বীকার করতে চায় না। মেয়েরা অনুভূতি প্রকাশ করে নিজেদের আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। তীব্র আত্মসমমানবোধ আছে এমন মেয়েরা ঈর্ষান্বিত হন না।
আত্মসমমানবোধ যাদের কম, আত্মবিশ্বাসের অভাবে যারা ভোগেন তারা ঈর্ষান্বিত বেশি হন।
আমরা অল্পতে কোনো কিছু না পেয়ে হতাশায় ডুবে যাওয়া কে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমাদের মনে হয় না, আমরা কেমন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি? শুধু ওপরের থেকে সাহায্য নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছি। কিন্তু অন্য কাউকে এগোতে সাহায্য করছি না বরং কীভাবে তাকে প্রতিহত করা যায়। হতে পারে শারীরিকভাবে, হতে পরে মানসিকভাবে, সেই চেষ্টা করছি। কিন্তু অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে যে সুখ আত্মপ্রশান্তি লুকিয়ে আছে তা উপভোগ করছি না। এগুলো কিন্তু মানসিক খোরাক জোগায়, কিন্তু আমরা এগুলো থেকে দূরে। তবে সুস্থ হবো কীভাবে? আমরা ছোটখাটো সব বিষয়ে অন্যর ভুল ধরতে ব্যস্ত, কিন্তু নিজের ভুলগুলো সংশোধন করতে তৎপর না। তাহলে আমাদের উন্নতি ঘটবে কেমন করে!
প্রশ্ন জাগে, তাহলে পরিত্রাণের উপায়? ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিবো কোথা’
আমাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। আমাদের মধ্যে এই অসুস্থতা সর্বাঙ্গে সর্বজনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। এত সহজে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। তবে আমরা চাইলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারি। নিজেদের নিয়ে খুশি থাকতে পারি। অন্যর সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে নিজেকে নিজের প্রতিযোগী হিসেবে গণ্য করতে পারি। কে কী বলল এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে নিজের মতো করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হতাশাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না, ধর্মীয় চর্চা করতে হবে। প্রতিটি ধর্মই অহিংসার নীতি শেখায়, আমরা আমাদের কে তদ্রুপ পথে পরিচালিত করতে পারলে মন ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকব। পরিশেষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে যেন এমন অহেতুক মানসিক বিকারগ্রস্ততা যেন প্রাধান্য না পায়। একটি সুখী অহিংস সমাজের প্রত্যাশা করি।