সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে চাহিদার তুলনায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও বাস্তবে এই ঘাটতি আরও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানী ঢাকায় তুলনামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বেশি থাকলেও লোডশেডিং হচ্ছে। কিন্তু জেলা এবং গ্রামীণ এলাকাগুলোয় দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে তীব্র গরমের মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা জাকির হুসেন বলেন, প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। এমনকি সাহরির সময়েও বিদ্যুৎ থাকে না। রোদে মাটি ফেটে যাচ্ছে, ক্ষেতে ঠিক মতো পানি দিতে পারছি না। অনেকের ধান, পাট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বরগুনার পাথরঘাটার বাসিন্দা দুলু বেগম বলছেন, ‘’প্রতিদিন পাঁচ ছয় ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকে না। পোলাপান পড়াশুনা করতে পারে না, গভীর রাতে বিদ্যুৎ চলে যায়, গরমে ঘরে কেউ ঘুমাতে পারে না। রাজশাহী, ফরিদপুর, রংপুর, বরিশালে কথা বলে অনেকটা একই চিত্র পাওয়া গেছে।
গরমের কারণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বিক্রি ও ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে, যার চাপ পড়ছে বিদ্যুতের ওপর। ফলে সারা দেশ জুড়ে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোয় বহুক্ষণ বিদ্যুৎ থাকছে না। বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। যদিও বাস্তবে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের খুব বেশি উৎপাদন করা যায় না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত আটই এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল প্রায় তিনশো মেগাওয়াট। পরদিন থেকে গরম বাড়ার সাথে সাথে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতিও বাড়তে শুরু করে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কারিগরি জটিলতায় কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া।
কারিগরি ত্রুটির কারণে রামপাল, আশুগঞ্জ নর্থ এবং আশুগঞ্জ ইস্ট- তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে এই তিনটি কেন্দ্র থেকে গ্রিডে এক হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘যার ওপর ভর করে এই গ্রীষ্ম কাটাবো বলে আমরা আশা করছিলাম, সেই রামপালের অর্ধেকটা বসে আছে। বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা অনেক কথা শুনেছি, কিন্তু আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ধারা, সেখানে খুব বেশি উন্নতি কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। লোডশেডিং থেকে বের হতে পারছি না।
তিনি মনে করেন, আগের কবছরের তুলনায় এবছরে তীব্র তাপদাহ তৈরি হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটা লোডশেডিংয়ের একটা বড় কারণ।
কিন্তু আমরা যেটা আশা করেছিলাম, বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো, পায়রা, রামপাল -যেগুলো এই গ্রীষ্মে আমাদের সংকট মেটাবে। কিন্তু সেটা তো দেখা যাচ্ছে না। এই দুটো মিলিয়ে আমার মনে হয় বর্তমান সমস্যাটা বড় হয়ে উঠেছে, বলছেন ড. বদরুল ইমাম।
গ্রীষ্ম তীব্র চাহিদা সামলাতে কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা নিলেও, সেটার বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছর দেশে ডলার সংকট তৈরি হওয়ার পর থেকে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ফলে বহুবছর পর গত বছর রেশনিং ভিত্তিতে লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
সেই সময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে সরকার ডিজেলের ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা করলেও তা খুব বেশি কমেনি। কারণ লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যক্তিগত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জেনারেটরে ডিজেল ব্যবহার করতে শুরু করেন।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই বছরেও সরকারকে সেই নীতিরই অনুসরণ করতে হতে পারে। সেটা হলে বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি। যার মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু হলেও সেখানেও কাঁচামাল সরবরাহ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। তবে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছিলেন, গরমের সময় কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, কোন সোর্স থেকে কতটা আসবে, সেটার একটা পরিকল্পনা তারা তৈরি করেছেন।
গ্রীষ্ম, রমজান এবং সেচের চাহিদা হিসাব করে ধরে কর্মকর্তারা ধারণা করেছেন, গরমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এই গরমের সময় আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারবো বলেই আশা করছি, বলেছিলেন মোহাম্মদ হোসাইন।
তবে এখন কর্মকর্তারা বলছেন, তীব্র গরমের কারণে হঠাৎ করে বিদ্যুতের চাহিদা তাদের ধারণার তুলনায় বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে রামপাল, আশুগঞ্জসহ বড় কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে একটি বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কয়লা সংকটের কারণে এই বছরের জানুয়ারিতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিছুদিন বসিয়ে রাখতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে গ্যাস সংকটের কারণে একদিকে যেমন গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পুরোদমে ব্যবহার করা যাচ্ছে না, তেমনি ডলার সংকটের কারণে তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পুরোপুরি ব্যবহার করছে না কর্তৃপক্ষ।
কয়লা সংকটের কারণে এই বছরের জানুয়ারিতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিছুদিন বসিয়ে রাখতে হয়েছিল।
কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে দুই হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সেটা পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না।
মোহাম্মদ হোসাইন সোমবার বলেছেন, আমরা আসলে আগে প্রেডিক্ট করেছিলাম, এবারে সামারের বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। এবার তো শুধু গ্রীষ্ম না, রমজান এবং সেচ মিলে আমরা ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা ধরেছিলাম, সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সেই টার্গেট অনুযায়ী, ১৫,৩০৪ মেগাওয়াট উৎপাদন করেছি।
আমরা কিন্তু রমজানের প্রথম দুই সপ্তাহ ভালোভাবেই কাটিয়েছি। বিড়ম্বনাটা আসছে গত পাঁচ-সাতদিন ধরে যেভাবে তাপদাহ, সেটাতো ৫০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা আমাদের ধারণা ছাড়িয়ে গেছে। যার ফলে আমরা যেরকম ভাবছিলাম, তার চেয়ে বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে, তিনি বলছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, লোডশেডিং বৃদ্ধির পাশাপাশি তীব্র গরম পড়তে থাকায় গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছে, সেটা তারাও বুঝতে পারছেন।
আমরা লোডশেডিং র্যাশনালাইজ করার চেষ্টা করছি। একতরফা গ্রামে গঞ্জে হয়তো লোডশেডিং বেশি হয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা একটা যৌক্তিক ব্যবস্থার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি, তিনি বলছেন।
ভারতের আদানি পাওয়ার থেকে পিক আওয়ারে ৭৪৮ মেগাওয়াট আর অফপিকে ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। এর বাইরে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। জুন নাগাদ আদানি পাওয়ার থেকে আরও বিদ্যুৎ আসবে বলে আশা করছে সরকার।
কর্মকর্তারা বলছেন, খুব তাড়াতাড়ি রামপাল এবং আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আবার চালু হয়ে যাবে বলে তারা আশা করছেন। তখন সরবরাহ কিছু বাড়বে।
এ ছাড়া সরকারের হাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে বর্তমানের বিপুল চাহিদা সামলানোর মতো বিকল্প আপাতত আর নেই। ফলে এই সংকট সামলাতে এখন আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অপেক্ষা করছে কর্তৃপক্ষ। তারা আশা করছেন, এই সপ্তাহ শেষে গরম অনেকটা কমে আসবে। আর গরম কমলে চাহিদাও কমবে, তখন বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।