রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলোয় সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ে যায় ক্ষতিকর লেজার লাইটের ব্যবহার। নির্দেশনা না থাকলেও নিজেদের ইচ্ছামতো এই লাইট ব্যবহার করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। চিকিৎসকরা বলছেন, লেজার লাইটের রশ্মি চোখের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পাশাপাশি অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, লেজার লাইটের কারণে বাড়তে পারে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
মঙ্গলবার রাত ১১টা। গাবতলীর পর্বত এলাকায় ওয়েলকাম পরিবহণের এক চালকের চোখে এসে পড়ে লেজার রশ্মি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হেলপারকে বলেন, ‘চোখ জ্বলে যাচ্ছে, পানির বোতলটা তাড়াতাড়ি দে।’ এরপর তাকে চোখে পানির ঝাপটা দিতে দেখা যায়। এ সময় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা তিনদিক দিয়ে লেজার লাইটের মাধ্যমে ওই এলাকায় যানবাহন সরান। তবে এই লাইটের ব্যবহারের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তাদের কেউ মুখ খুলেননি।
শুধু পর্বত এলাকা নয়, গত কয়েকদিন টেকনিক্যাল, মতিঝিল, পল্টন, শাহবাগ, কাওরান বাজার, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, বিজয় সরণি, সায়েন্স ল্যাব, মোহাম্মদপুর, উত্তরা এলাকায় ঘুরে যান নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের লেজার লাইট ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
রোববার কাওরান বাজার এলাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহণের চালক আবুল কালাম বলেন, লেজার লাইটের আলো চোখে পড়তেই চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। চলন্ত গাড়িতে এ ধরনের আলো চোখে পড়লে দুর্ঘটনার ভয় থাকে। তিনি বলেন, পাশ থেকে যে কোনো সময় অন্য একটি গাড়ি এসে মেরে (ধাক্কা) দিতে পারে।
বুধবার মৌমিতা পরিবহণের চালক আলী হোসেন বলেন, ১৫ দিন আগে এক রাতে টেকনিক্যাল এলাকায় সার্জেন্ট লেজার লাইট মারতেই আমার চোখে পড়ল। মনে হলো যেন চোখে মরিচের গুঁড়া পড়েছে। এতে চোখ লাল হয়ে যায়। তীব্র ব্যথা হয়। পরদিন ডিউটিতে না গিয়ে ডাক্তার দেখাই। দুইটা ড্রপ ব্যবহারের পর চোখ স্বাভাবিক হয়েছে।
এদিন দুপুরে মিরপুর-১০ নম্বরে মোটরসাইকেলচালক জামিল হোসেন বলেন, প্রায় প্রতিটি সিগন্যালেই ট্রাফিক পুলিশ লেজার লাইট ব্যবহার করছে। একবার লেজারের আলো চোখে পড়লে দুই-তিন মিনিট চোখে ঝাপসা দেখি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সড়কে চলাচলে সামান্য ত্রুটি পেলে তারা মামলা দিয়ে দেয়। অথচ তারা প্রকাশ্যে অনিয়ম করে যাচ্ছে। আমরা এসব অনিয়মের বিচার চাইব কার কাছে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য বলেন, লেজার লাইট ব্যবহারে নিষেধ আছে। কর্তৃপক্ষ থেকেই বলা আছে লেজার লাইট ব্যবহার না করার জন্য। এই লাইট ব্যবহার করলে যানবাহন সরাতে সুবিধা হয়, এ কারণেই অনেকে লেজার লাইট ব্যবহার করেন।
লেজার লাইটের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, লেজার লাইট মূলত সার্জারির প্রয়োজনে ব্যবহার হয়। এই লাইট সরাসরি কারও চোখে পড়লে রেটিনা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাই এই লাইটের ব্যবহার পরিহার করা উচিত।
অপর এক চিকিৎসক বলেন, দূর থেকে লেজার লাইটের আলো শরীরের অন্যান্য স্থানে পড়লে সমস্যা হয় না। সরাসরি চোখে পড়লে রেটিনা এবং কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্ক ব্যক্তি, যাদের রেটিনা কিংবা কর্নিয়া আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ওপর লেজার লাইটের ক্ষতিকর প্রভাব তুলনামূলক বেশি। এই লাইটের আলো কখনো কখনো অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
লেজার লাইট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার এসএম মেহেদী হাসান বলেন, আমার জানামতে লেজার লাইট ব্যবহারের নির্দেশনা নেই। লেজার লাইট ব্যবহারও হয় না। তবে কারও বিরুদ্ধে লেজার লাইট ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ট্রাফিক সিগন্যালে সড়কবাতি এবং ফ্লিকার লাইট দিয়েই যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার কথা। ট্রাফিক পুলিশকে অন্যান্য সরঞ্জামাদির পাশাপাশি ফ্লিকার লাইট সরবরাহ করা হয়েছে। তবে লেজার লাইট সরবরাহের বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ যদি ব্যক্তি উদ্যোগে এসব লাইট ব্যবহার করে থাকেন, তবে তা নিয়ম পরিপন্থি। এর জন্য তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, লেজার লাইটের ব্যবহার চালকদের চোখের ক্ষতির পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি বলেন, এমনিতেই সড়কে দুর্ঘটনা কমছে না। এর মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের লেজার লাইট ব্যবহার সত্যিই দুঃখজনক। ট্রাফিক পুলিশকে এ লাইট ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।