মহান বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রত্যাশা -আদিত্ব্য কামাল

মতামত, 16 December 2022, 97 বার পড়া হয়েছে,

লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় বাংলাদেশ। ডিসেম্বর এলেই দেশব্যাপী বিজয়ের ধ্বনি নতুন করে উচ্চারিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস বাঙালি জাতিসত্তার আত্মমর্যাদা, বীরত্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। স্বাধীনতার ৫১ বছরে দাঁড়িয়ে এ বাংলাদেশের আছে নানা অর্জন।

আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ই ডিসেম্বর সবচেয়ে আনন্দ ও গৌরবের একটি দিন। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই দিনে আমাদের প্রিয় স্বদেশ দখলদারমুক্ত হয়েছিল। লাখাে শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করেছিলাম। এই দিনটি তাই আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে স্বরণীয় দিন।

পৃথিবীতে কোনো জাতি চিরকাল ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে চায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত নানান ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আবেগ। তেমনই আমাদের বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। সবাই চায় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত জীবনযাপন করতে। আমাদের দেশের মানুষও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তি ছিনিয়ে এনেছে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। আর তা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। বাঙালির প্রতীক্ষা অবসানের দিন, শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দিন। এ দিনে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। দীর্ঘ নয় মাস অনেক রক্তের পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন অর্জন করে তাদের প্রিয় স্বাধীনতা। মুক্তিকামী জাতির কাছে সে দিনটি ছিল অনেক প্রতীক্ষিত একটি দিন। আজও বাঙালি জাতি অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে গেলেই ফিরে যায় সে দিনটির কাছে। তাই জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের আছে সুগভীর তাৎপর্য।

প্রতি বছর এই দিনটি ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয়। হাজারও রকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বিজয় দিবস পালন করি। বিজয় দিবসের এই দিনে তাই নানা কিছু আমাদের হৃদয়ে ভেসে উঠে। প্রশ্ন জাগে কিসের বিজয়? কেমন করে আমাদের এই বিজয় অর্জিত হলো? কে আমাদের শত্রু? কে আমাদের বন্ধু বা মিত্র? এই দিনটিকে ঘিরে সকল প্রশ্নর জন্ম হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ নামে দুটি দেশের জন্ম হয়। ঐদিন পর্যন্ত বৃটিশ আমাদের শাসন করে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। দীর্ঘ প্রায় দুই শত বছর ব্রিটিশ বেনিয়া আমাদের ভারতবর্ষকে শাসন-শোষণ করে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের বাংলাদেশ নানাভাবে পাকিস্তানী শাসক দল কর্তৃক শোষিত হচ্ছিল। অত্যাচার, অনাচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ১৯৪৭ সালের পর আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল মাতৃভাষার রক্ষার আন্দোলন। যখন জিন্নাহ বললেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, তক্ষণি প্রতিবাদ না না, বাংলা ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য স্মারকলিপি দেয়। তখন থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুরু। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, জব্বার, প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আজ বিশ্বজুড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস। ঐ দিনের স্মরণে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর ৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসে। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পূর্ব বাংলার মানুষ মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। সারা পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠিতা অর্জন করে। কাজেই স্বাভাবিকভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে পাকিস্তান শাসন করবেন। কিন্তু সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান তা করতে দিলেন না। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভুট্টোর সঙ্গে আতাত করে ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার উপর ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে হত্যা-নির্যাতন শুরু করে দেয়। কিন্তু ঐ দিনের পূর্বে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তার অমর ভাষণে জাতিকে নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার পথকে সুগম করলেন। তাই ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ আন্দোলনকামী বাংলার মানুষের উপর লেলিয়ে দেয়া পাকিস্তানী বাহিনী এক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ।

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পর থেকে মাত্র ৯ মাসে বাংলার দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীনতার দুয়ারে নিয়ে উপনীত হয়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সফলতা লাভ করে। লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমরা আমাদের বিজয় পতাকা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হই। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, মুক্তির দিবস। বিজয় দিবস আসলে আমাদের ভাবনা মনের হৃদয়ে উঁকি দিতে থাকে। কেন আমরা যুদ্ধ করেছি? কি জন্য লক্ষ লক্ষ তরুণ জীবন দিল? চেয়েছি কি? আমরা পেয়েছি কি? আমাদের যুদ্ধ, সংগ্রাম, ত্যাগ অনেকগুলো কারণকে নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল।

১৯৭০ সালে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও পাকিস্তানী বাহিনী গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করে। তার বিরুদ্ধে ছিল আমাদের প্রতিবাদ, সংগ্রাম এবং সর্ব শেষে যুদ্ধ। গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। তার বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা আসে। একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র আমরা লাভ করলাম। গণতন্ত্র মুক্তি পেল। আজ আমাদের দেশ স্বধীন আমাদের স্বাধীন সংসদ রয়েছে। আমাদের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশ পরিচালনা করছেন। আমাদের একটি স্বাধীন সেনাবাহিনী রয়েছে। আমাদের জাতীয় সত্তা আলাদা। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। দেশ আমাদের কর্তৃক স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্র কি সর্বস্তরে আশা আকাক্সক্ষা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি? বিজয় দিবসে এই সকল ভাবনা আমাদের মনকে বারবার দোলা দেয়।

অর্থনৈতিক মুক্তি : অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি। অর্থনেতিকভাবে বিশ্বের দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব বলেই আমাদের মুক্তি। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর অর্থনৈতিকভাবে আমরা স্বাধীন ছিলাম না। অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে। বৈষম্যের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে পড়ে। ১৯৫০ দশকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মোট বিনিয়োগ শতকরা ২১ ভাগ থেকে ২৬ ভাগ। ১৯৬০ এ তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় শতকরা ৩২ থেকে ৩৬ ভাগ। রেভিনিউ খাতে ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয় মোট ২৫৪ কোটি টাকা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৮৯৮ কোটি টাকা। এইভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে অত্র এলাকার মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছিল। নানাভাবে শোষণের ফলে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ছিল খুবই সীমিত। তাই আন্দোলন, তাই সর্ব শেষে মুক্তিযুদ্ধ। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের যুদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান অনেক। এখনো ৪০ অনেক মানুষ নিরক্ষর, লেখাপড়া জানে না। তাই স্বাধীনতা ৫১ বছরে এসে আমাদের মনে করে দেয়। আমাদের আরও উন্নত হতে হবে। আরও বেশি অর্থনৈতিক উন্নতি সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে আনতে হবে। যদিও আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। শীঘ্রই আমাদের উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে তথা ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুইটি আলাদা সমাজ কাঠামোর গড়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু মুসলিম তথা ইসলামের একটি লেবাস ব্যবহার করা হয়েছিল। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের শুধু সামাজিক কাঠামো স্বতন্ত্র ছিল তাই নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিও ছিল ভিন্ন ইসলামী ঐতিহ্য এবং হিন্দু বৌদ্ধ সংস্কৃতির গভীর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠে ইসলামের নিবারণ অথচ অনমনীয় নীতি শুদ্ধ আদলে এবং হিন্দু ধর্মের উদার ও গ্রহণযোগ্যতার তীর ঘেঁষে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি ছিল অনেকটা গোঁড়া ও একাত্মবাদী। রাজনৈতিক ও সামাজিক এই পার্থক্য দুই পাকিস্তানকে আলাদা করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সর্বোপরি হত্যা, গুম, নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে আসে। অতি অল্প সময়ে মাত্র ৯ মাসে আমরা আমাদের মুক্তির স্থানে পৌঁছে গেলাম। আজ আমরা এক জাতি, একই সংস্কৃতিতে জীবনযাপন করি। কিন্তু তবুও আমাদের মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এই চার জাতির পর আমাদের মধ্যে বয়ে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠী।

বিজয় দিবসে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস মনে করে দেয়। ছয় দফা কর্মসূচিভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন প্রথম থেকেই ছিল অত্যন্ত গতিশীল এবং জনসমর্থনপুষ্ট। ছয় দফা বাঙালির হৃদয় মনে এমনভাবে স্থাপিত হয়েছিল যেন এক জাতি, এক দেশ, এক নেতা এক আন্দোলন। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে বিজয় অর্জন করে। এবং মহিলাদের ৭টি আসনও আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এক রেকর্ড স্থাপন করে। নির্বাচনের এই ফলাফল ছিল আশাতীত এবং নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করেছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হবে। কিন্তু পাকিস্তনী শাসনকারী এলিটবৃন্দ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন না করার ক্ষেত্রে ছিল অনমনীয়। এমনকি বাঙালি আধিপত্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে তারা রাজি ছিল না। ৩ মার্চ ১৯৭১ সালে নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত রেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চের ঘোষণা থেকে ছিল এক ক্রান্তিলগ্ন। এমনিতে তাই ছয় দফা দাবি অচিরে রূপ নিল একদফা দাবিতে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে। আজকের বিজয় দিবসে এই সকল ইতিহাস আমাদের মনে করে দেয় গণতন্ত্রের সীমা রেখাকে। আমরা কি সেই গণতন্ত্রের চর্চার মর্যাদা দিতে পেরেছি! দেশে বিদেশে কি আমাদের সেই মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। না পাইনি। তাই আমাদের আরও অনেক বেশি দূর পাড়ি দিতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সংগ্রামকে আরও বেশি বলীয়ান করতে হবে। গণতন্ত্রকে সম্মান করতে শিখতে হবে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের বিজয় দিবস হোক আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণের দিবস।

আমরা আমাদের বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু দারিদ্র্র্যকে আমরা জয় করতে পারিনি। আমাদের এখনকার সংগ্রাম হতে সমান, দেশ দারিদ্র্য হঠাও আন্দোলন। দেশের এখন ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের নিচে রয়েছে। প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষার আরো থেকে বঞ্চিত। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদেরকে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেক অনেক কমিয়ে আনতে হবে। উপায় কি? কিভাবে আমরা আমাদের দরিদ্রতার সীমাতে কমিয়ে আনতে পারি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল অস্ত্র ছিল আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি চাই। রাজনৈতিক মুক্তি আমাদের এসেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি এখনও পুরোপুরি আমরা লাভ করতে পারি নাই। সরকার দারিদ্র্য দূর করার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে যাচ্ছেন।

প্রতিটি গ্রামে আমাদের এখনও প্রাইমারী স্কুল নাই। সরকার সকল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আওতায় আনার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখনও তা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছর শেষে এখনও আমরা দুর্নীতিকে ডুবে রয়েছে। আমাদের সকল অর্জন দুর্নীতি নামক দানবটি খেয়ে ফেলেছে। তাই সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে হবে। দুর্নীতি নামক বস্তু সম্পর্কে আমাদের সকলের সমস্বরে না বলতে হবে। বিজয় দিবসে আমাদের শিক্ষা এখন হতে হবে দুর্নীতিকে ‘না’ বলা। আমরা কি সকলে দুর্নীতিকে ‘না’ বলার সৎসাহস দেখাতে পারব! আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে। এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের ১৫ বছর অতিক্রম করলো। দুর্নীতি দমন কমিশন কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে, তারা সঠিকভাবে দুর্নীতি দমন করতে কাজ করতে পারছে বা করছে! রাষ্ট্রকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন করে দিতে হবে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যত দিন দুর্নীতি দমন কমিশন থাকবে তত দিন দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন বা বলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কমিশন বলতে পারেন। সরকার ইচ্ছা করলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করতে পারেন। কন্ট্রোল করতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে স্বাধীনভাবেও কাজ করাতে পারেন। এই প্রতিষ্ঠানকে সকল রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। তা না হলে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। দুর্নীতিকে সহনশীল পর্যায়েও রাখা যাবে না। পৃথিবীর সকল দেশে দুর্নীতি রয়েছে। কোথাও কোথাও অসহনশীল পর্যায়ে, কোথাও বা সহনশীল পর্যায়ে দুর্নীতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের মত একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে দুর্নীতিকে অত্যন্ত সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিজয় দিবসে জাতি সকলের নিকট সেই আশা পোষণ করে।

আমাদের সংগ্রাম হচ্ছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশের জন্য। কিন্তু আজ আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে। সমাজের সকল স্তর থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দারুণ অভাব। ১৯৭১ সালে আমরা সকল অন্যায়, অবিচার, মূল্যহীন জীবনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি। তা পরবর্তীতে মুক্তি সংগ্রামে রূপ নেয়। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেও আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারি নাই। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় দেশে স্থাপিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাসের হারও বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা, মনুষ্যত্বের শিক্ষা আমরা দিতে এখনও সক্ষম হয় নাই। বিজয় দিবসে আমাদের মনে এই সকল চিন্তা নানাভাবে ঘোরপাক খাচ্ছে। এই দিনে আমাদেরকে এই সকল বিষয়ে আরও শক্তিশালী হওয়ার দৃঢ়তা শিক্ষা দেয়।

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে যাতে করে শিশুকাল থেকে ছাত্রছাত্রীগণ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে নিজকে গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষা ছাড়া তথা সুশিক্ষা ছাড়া কোনক্রমেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা হবে না। মানুষ সত্যিকার মানুষ হতে পারবে না। সার্টিফিকেট সম্পন্ন কিছু যুবক-যুবতী তৈরি করলে দেশ কখনও মৌলিক শিক্ষা লাভ করতে পারবে না। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নিজেদের মধ্যে করতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকমমণ্ডলী ছাড়া নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী তৈরি হবে না। তাই প্রথমে শিক্ষককে সুশিক্ষক হতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকম-লী তৈরির জন্য কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিজয় দিবস আমাদেরকে তা শিক্ষা দেয় তা দাবি করে।

বিজয় দিবসে নানা ভাবান আমাদের মনের মধ্যে এসে পড়ে। ১৯৭১ সালে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কোন বিভেদ, অনৈক্য আমাদের মধ্যে ছিল না। রাজনৈতিকভাবে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ করেছি। সেই ঐক্যের রাজনীতি আমাদের এখন বড় প্রয়োজন। জাতি আজ প্রায় দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জাতীয় বড় বড় ইস্যুতে পর্যন্ত আমরা সকল রাজনৈতিক দল এক সুরে কথা বলতে পারছি না। বিগত জাতীয় নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ হয় নাই বলে দেশে বিদেশে তা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারে নাই। তাই আগামী নির্বাচন সরকার চাচ্ছেন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সকলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের দেশের চেহারা পাল্টে দেবে। দেশে বিদেশে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ ও এখন বৃদ্ধি পাবে। আশা করা যায় আগামী নির্বাচনকে একটি মডেল হিসাবে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ গ্রহণ করে জাতিকে সকল কালিমা থেকে মুক্ত করবে। তাই সরকারকে সকলের পূর্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। মেরুদ-হীন নির্বাচন কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কখনও আশা করা যায় না। আজকের বিজয় দিবসে আমাদের প্রাণের দাবি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী জবাবদিহিমূলক সরকার উপহার দেয়া।

আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগ রয়েছে। সরকার বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এখন বিচার বিভাগের প্রয়োজন তাদের যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার নজির স্থাপন করা। বিচারহীনতাকে বের হয়ে আসা। আইনের শাসন সকলের নিকট সমান ও গ্রহণযোগ্য তা প্রমাণ করার জন্য বিচার বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। সুবিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আজও সাধারণ মানুষ অভিযোগ করে ন্যায় বিচার হতে তারা বঞ্চিত। এই অভিযোগ যাতে কেউ করতে না পারে সেই রকম গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে বিচার বিভাগ হতে হবে। আইনের শাসনকে সহজ ও সহজ লক্ষ্য করতে হবে। বিচার কাজের খরচ অনেক বেশি। সাধারণ একজন নাগরিক ন্যায়বিচার আসায় অধিক খরচের জন্য আদালতে যেতে পারে না। বিশেষ করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে নানা খরচ অধিক হওয়ার কারণে সাধারণ আয়ের মানুষ মামলা পরিচালনা করতে পারে না। খরচ কমাতে হবে। খরচ কমানোর জন্য সরকারও বিচার বিভাগকে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

অনেক না পাওয়ার মধ্যেও আমাদের প্রাপ্তি কম নয়। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন শিক্ষায় যথেষ্ট এগিয়েছে। দেশের বাইরেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। যােগাযােগব্যবস্থা, পল্লি জনপদে বিদ্যুতায়ন, স্বাস্থ্যখাত ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখযােগ্য উন্নতি ঘটেছে। ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুখ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি দিন দিনই বাড়ছে। তৈরি পােশাক, চামড়া, হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদির পর এবার জাহাজ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে।

এক সাগর রক্ত আর ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সোনার বাংলাদেশ। একটি নতুন দেশকে সােনার দেশ হিসেবে গড়ে তােলার দায়িত্ব সকলের। বিজয় দিবস স্বাধীনতাকামী বাঙালির পবিত্র চেতনার ধারক। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।

-আদিত্ব্য কামাল,সম্পাদক- জনতার খবর