কারাগারে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, শারীরিক নির্যাতন, খাবার না দেওয়া, মজুরি ছাড়া কাজ করানোসহ নানা দুর্ভোগ সহ্য করতে হয় তাদের। লিবিয়ায় থাকা এমন বাংলাদেশিদের দুর্দশা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। আফ্রিকার সাংবাদিকদের কাছ থেকে বেশ কিছু চিঠি পাওয়ার পর বিবিসির ইসমাইল এইনাশে এক তরুণের সঙ্গে দেখা করেন।
সেখানেই সাক্ষাৎকারে তিনি লিবিয়ায় তার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। পরিচয় প্রকাশ না করে বিবিসি ওই তরুণের ছদ্মনাম দিয়েছে আলী। ২০১৯ সালে তার বয়স যখন ১৯ বছর, তখন তিনি তার বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে কাজের খোঁজে লিবিয়ার উদ্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ এক যাত্রা শুরু করেন।
এক দালালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই আলী এ ব্যাপারে উৎসাহী হন। প্রকৃতপক্ষে এ দালালরা হলেন মানব পাচারকারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁদ পেতে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ বাংলাদেশিদের আকৃষ্ট করে থাকেন তারা।
মুক্তিপণের জন্য আটক : লিবিয়ায় যেতে আলীর এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। বিমানবন্দরে নামার পরই একদল লোক তাকে নিয়ে যান। এসব লোক সেখানে দালালদের হয়ে কাজ করেন। তারা বিমানবন্দর থেকে আলীকে এক কারাগারে নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর তারা আলীর কাছে থাকা অবশিষ্ট টাকাকড়ি নিয়ে নেন। এরপর মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে সেখানে আটকে রাখেন।
লিবিয়ায় এক কারাগারে ছেলে আটক থাকার খবর পান আলীর বাবা-মা। ছেলেকে মুক্ত করার জন্য বাড়িতে থাকা শেষ দুটি গরুও বিক্রি করে দেন তারা। ছোট একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয় আলীকে। যেখানে শোয়ার মতো কোনো বিছানাও নেই।
ওই কক্ষে তার মতো আরও ১৫ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের মধ্যে যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেননি, তাদের খেতে দেওয়া তো হয়ই না, উলটো নানাভাবে তাদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হয়। আলী জানান, ‘আমার সামনেই তারা একজনকে মারধর করছিল। মার খেয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল তার। তবুও তাকে সাহায্য করেনি বা হাসপাতালে নেয়নি।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লিবিয়ায় পাচারকারীর হাতে বন্দি বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। ২০২০ সালের মে মাসে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির একটি গুদামঘরে একসঙ্গে ৩০ জন অভিবাসীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। সেবার বেঁচে যাওয়া একজন বলেন, এসব মানুষের পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেনি বলেই তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
মজুরি ছাড়াই কাজ : অবশেষে যখন আলী মুক্ত, তখন বেনগাজিতে একটি পানি বোতলজাত কারখানায় তিন মাস মানব পাচারকারীদের জন্য কাজ করছিলেন। পাচারকারীদের হাত থেকে কোনোমতে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি চলে যান রাজধানী ত্রিপোলিতে।
সেখানে গিয়ে একটি টালি কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। বর্তমানে লিবিয়ায় থাকা আনুমানিক ২০ হাজার বাংলাদেশির অনেকের মতো আলীও অত্যাচারিত হয়েছেন। বেতন ও ছুটি ছাড়া অসহনীয়ভাবে কাজ করেছেন। আলী বলেন, ‘কাজ বন্ধ করলেই আমাদের মারধর ও লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হতো। কারখানার মালিকের সঙ্গেই থাকতেন আলী। তবে তাদের চোখের আড়াল হতে দিতেন না।
তালাবদ্ধ করে রাখা হতো সব সময়। আলী বলেন, ‘মালিক আমাদের কাজে নিয়ে যেতেন এবং কাজ শেষ হলে আমাদের সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আমাদের নজরদারির জন্য দুজন রক্ষীও ছিল। ওই কাজের জন্য আমাদের কোনো মজুরি দেওয়া হতো না।
এ ছাড়া সেখানে আমাদের পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না। পরে লিবিয়ার এক নাগরিক আলীকে পালিয়ে একটি মসজিদে আশ্রয় নিতে সাহায্য করেন। এরপরও তার মনে হয়, তার একমাত্র উপায় হচ্ছে পাচারকারীদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করা। এবার সিদ্ধান্ত নেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাবেন ইতালি।
সাগরে হাঙর : ছেলের ইতালি যাওয়ার কথা জানার পর আবার আলীর বাবা-মা ছেলের জন্য ঋণ করে সাড়ে তিন লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দেন। গত বছরের জুলাই মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ির ঘটনা আলীর ও ডিঙি নৌকায় থাকা অন্য ৭৯ অভিবাসীদের জন্য আরেকটি ভয়ংকর অগ্নিপরীক্ষায় পরিণত হয়েছিল।
আলী বলেন, ‘পুরো দুই দিন সাগর ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখছিলাম না। হঠাৎ আমাদের কাছেই দুটি হাঙর দেখতে পেলাম। ওই সময় কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন যে, হাঙরগুলো আমাদের খেয়ে ফেলার জন্য আসছে। আমি তখন মনে করেছিলাম, এবার বুঝি আমরা শেষ।’ ইতালির উপকূলীয় শহর সিসিলিতে স্থানান্তরের আগে ল্যাম্পেডুসা নামের একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় আলীদের। আলী এখন সিসিলির রাজধানী পলিমারোর উপকণ্ঠে একটি বড় অভিবাসী আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে অন্য অনেক দেশের এমন অনেক তরুণ রয়েছেন।