যে ব্যক্তির নিকট ঈদের দিন তার ও তার পরিবারের খাদ্য-খোরাক বিদ্যমান রয়েছে এবং সেই সাথে ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য আছে তার জন্য আল্লাহ্ তায়ালা ফিতরা ওয়াজিব করেছেন। অর্থাৎ কারো কাছে একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান থাকলে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে তাকে ফিতরা আদায় করে নিতে হবে।
বাড়ির কাজের লোক বা চাকর-চাকরানীদের জন্য ফিতরা দেয়া বাড়ির মালিকের জন্য আবশ্যক নয়। তবে গরীব মানুষ হিসেবে ফিতরা দিলে সওয়াব পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মালিক নিজের ও নিজ পরিবারের যেভাবে ফিতরা দিবে সেভাবেই বাড়ির কর্মচারীদের ফিতরা দিবে।
ফিতরা আদায় করার উত্তম সময় হচ্ছে ঈদের নামাজ বের হওয়ার পূর্বক্ষণে। অর্থাৎ ফিতরা দিয়ে নামাজ পড়তে যাওয়া।
রাসুলুল্লাহ সা. ঈদের নামাজ আদায়ের পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিতেন। (সহি বুখারি : ১৫০৩)
ইবনে উমর থেকে বর্ণিত, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দেন লোকদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বে।’ (বুখারী, নং ১৫০৯ )
তবে ফিতরা দেয়ার সময় শুরু হয় রমযানের শেষ দিনে সূর্য ডোবার সাথে সাথে। (সউদী ফাতাওয়া কমিটি ৯/৩৭৩)
কেউ ঈদের এক দুই দিন পূর্বেও তা দিতে পারে কারণ সাহাবিদের মধ্যে কেউ কেউ ঈদের এক দুই দিন পূর্বে তা আদায় করতেন। (বুখারী, নং ১৫১১)
কেউ ঈদের পরে ফিতরা দিলে সেটা সাধারণ দান হিসাবে গণ্য হবে এবং সে ফিতরার বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদা হতে বঞ্চিত থাকবে। (আবু দাউদ, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: ফিতরের যাকাত)
টাকা-পয়সা দ্বারা ফিতরা না দেয়ার চেয়ে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা দেয়া উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দিনার এবং দিরহামের প্রচলন ছিল এবং সে কালেও ফকির ও মিসকিনদের তা প্রয়োজন হত। তা দ্বারা তারা জিনিস-পত্র ক্রয়-বিক্রয় করত। তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুদ্রা দ্বারা ফিতরা নির্ধারণ না করে খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। হাদীস মতে, খাদ্যবস্তু দ্বারাই ফিতরা আদায় করা সুন্নত। আর এটাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত।
ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (স.) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব যাকাতুল ফিতরা হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন’। (বুখারী-মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৫)
তাই ফিতরা আদায় করতে হবে প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু এক ‘সা’ খাদ্যশস্য দিয়ে। ‘সা’ হচ্ছে তৎকালীন সময়ের এক ধরনের ওজন করার পাত্র। নবী করীম (স.) এর যুগের ‘সা’ হিসাবে এক ‘সা’ তে সবচেয়ে ভাল গম দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম হয়। বিভিন্ন দ্রব্যের নিজস্ব ওজনের ভিত্তিতে ‘সা’ এর ওজন বিভিন্ন হয়। এক সা চাউল প্রায় দুই কেজি পাঁচশ গ্রাম হয়। তবে ওজন হিসাবে এক ‘সা’ গম, যব, ভুট্টা, খেজুর ইত্যাদি দুই কেজি দুইশ পঁচিশ গ্রামের কিছু এদিক সেদিক হয়ে থাকে। তাই সতর্কতা হিসেবে তিন কেজি নির্ধারণ করা ভালো।
কেন দিবেন ফিতরা ?
একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা পালন করতে গিয়ে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, যার কারণে রোজা তার ভঙ্গ হয়ে যায় না, কিন্তু রোজার ত্রুটি হয়। রোজার এ ত্রুটি মার্জনার জন্যই সাদাকাতুল ফিতর; যেমন একজন রোজাদার ব্যক্তি দিনের বেলায় পানাহার করেনি, স্ত্রী ব্যবহার করেনি, যার কারণে তার রোজা নষ্ট হয়নি, কিন্তু পরনিন্দা চর্চা করেছে, অশ্লীল কথাবার্তা বলেছে, অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলেছে, এতে রোজার ত্রুটি হয়েছে। এ থেকে রোজাকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করার জন্যই সাদাকাতুল ফিতর।
গরীব-দরিদ্র মানুষগুলো এই সমাজেরই মানুষ। তারা সারা বছরই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থাকে। তারা কমপক্ষে ঈদের দিনের একদিন যাতে ঈদ আনন্দে সকলের সাথে শরীক হতে পারে; এজন্য তাদের কিছু খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া।
দীর্ঘ এক মাস উপবাস থাকার পর আল্লাহ মেহেরবাণী করে ঈদের দিনে পানাহারের অনুমতি দিয়েছেন, তারই শুকরিয়াস্বরূপ সাদাকাতুল ফিতর।
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজাকে অপ্রয়োজনীয় ও অশ্লীল কথাবার্তা ও কার্যকলাপ থেকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য এবং মিসকীনদের কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা, বায়হাকী)
অন্য হাদীসে রয়েছে : ‘তাদের আজকের দিনে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরা থেকে অমুখাপেক্ষী রাখ’ (বায়হাকী, দারু কুতনী)
কাকে দিবেন ফিতরা ?
সাদাকাতুল ফিতর পাওয়ার উপযুক্ত তারাই, যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত। তবে সমাজের দরিদ্র-অনাথ এবং নিজের গরীব আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে দেয়াটাই অধিক উত্তম। কেননা হাদীসে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দরিদ্রের খাবারের ব্যবস্থা করা। অতএব সাদাকাতুল ফিতর একমাত্র দরিদ্র-অনাথকে দিয়ে ঈদের আনন্দে তাদের শামিল করবে এবং নিজের রোজাকে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পরিচ্ছন্ন করবে- এটাই হবে সাদাকাতুল ফিতরের লক্ষ্য।