সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি -আদিত্ব্য কামাল

মতামত, 21 March 2022, 213 বার পড়া হয়েছে,
আজ ২১শে মার্চ, বিশ্ব কবিতা দিবস। পৃথিবীর বুকে বহুযুগ ধরে প্রেম থেকে আন্দোলন, সবকিছুরই প্রকাশ ঘটেছে কবিতায়। একগুচ্ছ শব্দমালা কখনও হয়ে উঠেছে ঘুমপাড়ানি গান আবার কখনও হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের আগুন।
দিনটি বিশ্বের আনাছে কানাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবি ও কবিতা পাঠকদের দিন। কবিতা ভাবের সুন্দর রূপ। কবিতার বিমূর্ততার মতো অনুভূতি ও আবেগের আধিক্য আর কোনো সাহিত্যে তৈরি হয় না।
সাহিত্যের অনেক শাখা-প্রশাখার সবচেয়ে আদিম যে পর্ব, সেটি হলো কবিতা। সেই কবিতার প্রতি সম্মান জানিয়ে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯৯ সাল থেকে ২১ মার্চ দিনটিতে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’।
ইংলিশদের ওয়ার্ডসওয়ার্থ কিংবা শেক্সপিয়ার, আইরিশদের ইয়েটস, ফ্রেঞ্চদের বদলেয়ার, ইতালির দান্তে, জার্মানির গ্যেটে, পার্সিয়ানদের হাফিজ, উর্দু ভাষার গালিব কিংবা বাঙালির রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ–যার কথাই বলা হোক না কেন, সাহিত্যের সঙ্গে যারা পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাদের সিংহভাগই হচ্ছেন কবি।
আবার কবিদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে এক একটি জাতির আদি ইতিহাস। সেটা হোক ইলিয়াড, অডেসি, বিউলফ, ইনফার্নো, রামায়ণ, মহাভারত কিংবা মেঘনাদ বধ–এর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে একেকটি জাতির ইতিহাস, বিশ্বাস, রাজনীতি, দর্শন সর্বোপরি একটি সামগ্রিক আদর্শ।
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায়ই কবিদের নিয়ে অনেক উচ্চুক্তি রয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটি জায়েজও বটে। যেমনটি বলা হয়ে থাকে হাফিজের ক্ষেত্রে। ঈশ্বর যা বলতে চান, তা নাকি হাফিজের জিব দিয়ে শব্দের মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। আবার কোনো এক লেখক ঔপন্যাসিক ও কবির পার্থক্য করতে গিয়ে বলেছেন, কবি যখন কোনো পথ দিয়ে হেঁটে যান, অন্য সাহিত্যিকরা সসম্মানে সেই পথ ছেড়ে দেন।
কিন্তু কাকে দেওয়া হবে কবির সেই মর্যাদা কিংবা কোন লেখাকেই-বা বলা হবে কবিতা? এমন প্রশ্নের এক লাইনের কোনো উত্তর নেই। এমনকি বিস্তৃত আলোচনা শেষেও হয়তো পৌঁছানো যাবে না কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে। তবে নানা সময়ে অনেক সমালোচক, সাহিত্যিক ও কবি নানা সংজ্ঞায় কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন।
কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘আবেগ যখন ভাবনা খুঁজে পায় আর ভাবনা যখন খুঁজে পায় শব্দ, তখন জন্ম নেয় কবিতা।’
টি এস ইলিয়ট বলেছেন, ‘কবিতা সবসময় আবেগপ্রসূত নয়; বরং কিছু সময় আবেগ থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যম। কবিতা ব্যক্তিত্বের প্রকাশক নয়, মাঝেমধ্যে কবিতা হচ্ছে ব্যক্তিমানুষ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর একটি পথ। কিন্তু সবার আগে জরুরি হচ্ছে সেই কবিসুলভ আবেগ ও ব্যক্তিত্বটি থাকা, যেখান থেকে একজন কবি প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছেন।
আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বাংলা কবিতার নতুন যুগের এক দিকপাল বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয়, যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা–এই সব কটি ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।
কিন্তু কবিতা আসলে কী? কীভাবে বোঝা যাবে কবিতা হচ্ছে? এ ব্যাপারে নানা মুনির রয়েছে নানা মত। তবে উত্তরাধুনিক যুগের বাংলাদেশের কবি শহীদ কাদরি অনেকটাই যথার্থ বলেছেন, পুরোনো কিছুকে নতুন কোনো রূপে দেখা। উদাহরণস্বরূপ চাঁদের কথা বলা যায়। অনেক কবি চাঁদকে দেখেছেন প্রিয়তমার মুখ হিসেবে, সুকান্তের কাছে চাঁদ ঝলসানো রুটি, বিট জেনারেশন থেকে অনুপ্রাণিত কবিদের কাছে চাঁদ হচ্ছে ছত্রাক জমা এক বাটি বাসি ফিরনি। সুতরাং যুগের তালে কবিতা বদলেছে তার রূপে, সংজ্ঞায় ও স্বাতন্ত্র্যে।
অনেকটা রাশিয়ান সাহিত্য সমালোচক ভ্লাদিমির নভোকভের মতো, ‘অপরিচিতিকরণ’। দেখার চোখকে গভীরে নিয়ে যাওয়া। সেই চোখের মাঝে যে সৌন্দর্যই ধরা পড়তে হবে এমন নয়। চোখের মাঝে ধরা পড়তে পারে শঙ্কা, নৃশংসতা, হাহাকার, বেদনা কিংবা অন্যকিছু। সর্বপোরি একজন কবিকে হয়ে উঠতে হবে নান্দনিক। তাহলেই কবিতা কেবল ছন্দবদ্ধ শব্দের মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে কবিতা হয়ে উঠবে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে বাজারে মুখরোচক গল্প, উপন্যাস কিংবা কমিকসের ভিড়ে কবিতা কি তার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। এককথায় প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে ‘না’। কেননা, মানুষ যতদিন থাকবে, মানুষের ভেতরে নান্দনিকতা যতদিন থাকবে, কবিতার চাহিদা ঠিক ততদিনই টিকে থাকবে।
আজও চাকরি না পাওয়া কোনো এক বেকার যুবকের মুখে ফুটে ওঠে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সেই অনবদ্য লাইন: ‘বন্ধুরা সব বিত্তে বাড়ে, চিত্তে বাড়ে/বাড়ে শনৈঃ গৃহস্থালি, আমার তবু বয়স হয় না, বুদ্ধি হয় না।’ কিংবা ক্ষুধার্ত পাকস্থলী নিয়ে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হয়তো কেউ বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছে রফিক আজাদের কবিতা: ‘চলাচলকারী পথচারী, নিতম্বপ্রধান নারী/উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি/আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ/ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।’ বিপ্লবের মাঠে, মিছিলের মাঝখানে হয়তো কোনো যুবক তার প্রেমিকার কথা মনে করে নীরবে আবৃত্তি করে যাচ্ছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন: ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
পৃথিবীর আদিমতম সাহিত্যের এই জ্যেষ্ঠ সন্তান কালের বিবর্তনে তার রূপ বদলেছে বহুবার। সামনেও বদলাবে কবিতার রূপ, ধাঁচ, শব্দ, আবেগ ও সংলাপ। গ্রহণযোগ্যতার ধরন বদলাবে, বদলাবে প্রত্যাখ্যানের ভাষা। কিন্তু ভালো কবিতা যখনই রচিত হবে, তা গেঁথে থাকবে মানুষের মনে। জেগে থাকবে কবির মনে ভালো কবিতা লেখার সেই অমোঘ তৃষ্ণা। অনেকটা নাজিম হিকমতের কবিতার লাইনের মতো: ‘যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর/তা আজও আমরা দেখিনি। সব থেকে সুন্দর শিশু/আজও বেড়ে ওঠেনি/আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো/আজও আমরা পাইনি। মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই। সে কথা আজও আমি বলিনি।’ হয়তো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর কবিতাটি আজ অবধি লেখা হয়নি। আজ অবধি আমরা পড়িনি সুন্দর সেই পঙ্‌ক্তিমালাগুলো।
তেইশ বছর ধরে ইউনেস্কোর কল্যাণে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব কবিতা দিবস। এর আগে পশ্চিমা দেশগুলোতে বিখ্যাত রোমান কবি ভার্জিলের জন্মদিন ধরে কবিতা দিবস পালন করা হলেও এর বিশ্বব্যাপী রূপ পায় ইউনেস্কোর উদ্যোগের মাধ্যমে। মূলত বিশ্বের কবিদের সম্মান প্রদানের স্বার্থেই প্রতিবছর এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।
ইউনেস্কোর অধিবেশনে এই দিবস ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক কবিতা আন্দোলনগুলোকে নতুন করে স্বীকৃতি দান করবে। এ উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব কবিতা দিবস।
যদিও এর আগে ৫ অক্টোবর বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে পালিত হতো। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগস্টাসের রাজকবি ভার্জিলের জন্মদিন স্মরণে ১৫ অক্টোবর এই দিন পালনের প্রথা শুরু হয়। ইউনেস্কো ঘোষিত ২১ মার্চকে অগ্রাহ্য করে এখনও কোথাও কোথাও অক্টোবর মাসেই পালিত হয় কবিতা দিবস। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এ দিবসটি পালিত হয় এপ্রিলে।
কবিতা সাহিত্যের প্রাচীনতম একটি শাখা। কবিতা আবেগ এবং পাঠকের কল্পনাকে প্রকাশ করার জন্য ছন্দ এবং চিত্র ব্যবহার করে। মানব মনের অনবদ্য ধ্যান ও মননের বহি:প্রকাশই কবিতা। ভাবনার অনুসরণ থেকে বেড়ে উঠা পঙ্গক্তিমালাই কবিতা। কবিতা ভাব প্রকাশের ভাষা, প্রগাড় বোধের নান্দনিক প্রতিচ্ছবি। কবিতা প্রতিবাদের ভাষা, অধিকারের ভাষা। কবিতা হচ্ছে শব্দগুলোর সুগভীর গাঁথনি হৃদয়ের অনবদ্য সুখানুভূতি, কবিতা কালের সাথী, সমকালের মুখপত্র, কখনও দগ্ধ হৃদয়ের আর্তনাদ।
আদিত্ব্য কামাল,বার্তা সম্পাদক জনতার খবর