১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল নবীনগরের বড়াইল গ্রামে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ লোকদের হত্যার পর থেকে তৎকালীন সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাসিমের (পরে সেনাপ্রধান) নির্দেশে বীরমুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা বড়াইল গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন ও তাদের দোসর শান্তি কমিটির লুটপাটের তথ্যসহ সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতির ওপর একটি রিপোর্ট নিয়ে তিনি ভারতে ফিরে যান। সেখান থেকে সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লাহর সম্মতিক্রমে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ও ৪০ সদস্যের একটি দলসহ জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বড়াইল গ্রামে ফিরে এসে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলেন। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরও একটি মুক্তিযোদ্ধা দল আধুনিক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ বড়াইল ক্যাম্পে এসে যোগ দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বড়াইল ও খাড়ঘর গ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাঁটি ছিল। বড়াইল বাজার ক্যাম্প থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে তখন বড় বড় গেরিলা অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়। ভৈরব রেল সেতু ধ্বংস, লালপুরে মেঘনা নদীতে পাকবাহিনীর খাদ্য ভর্তি কার্গো ডুবিয়ে দেওয়া এবং বদগুনি খালের যুদ্ধসহ আরও অনেক বড় বড় অভিযান চালানো হয় এখান থেকেই। এ কারণে পাকবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় গ্রাম দু’টি।
নবীনগর উপজেলা সদরে পাকবাহিনীর প্রথম আগমন ঘটে ২০ জুন ১৯৭১। আশুগঞ্জ থেকে লঞ্চযোগে নবীনগর এসে নারায়নপুর পর্যন্ত টহল দেয়। নারায়নপুর যাওয়ার পথে পাক সেনাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আলীয়াবাদ গ্রামের জনৈক আব্দুর রৌফের চার বছরের শিশু কন্যা আফরোজা বেগম মিতু শহীদ বরণ করেন। ঐ দিনই আবার লঞ্চযোগে আশুগঞ্জ চলে যায়। তবে যাওয়ার সময় বেশ কিছু লোককে ধরে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর আবার এসে হাইস্কুলের বিল্ডিংয়ে স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে থাকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরকে দখল করার লক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাঁটি তৈরী করে। এখান থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিদের প্রথম আক্রমণে উপজেলার বিটঘর ইউনিয়নের গুড়িগ্রামে মিরপুর গ্রামের শহীদ মিয়া পাক সৈন্যের গুলিতে প্রথম শহীদ হন। শিবপুর ইউনিয়নের মীরপুরে বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস শহীদকে কবরস্থ করা হয়। ভোলাচং গ্রামে অভিযান চালিয়ে ডা.হরিদাস চক্রবর্তী সহ ৫ জনকে হত্যা করে, সিরামপুর গ্রামে পাক অভিষানে ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। পরে গ্রামবাসী আপনজনের লাশ নিজেদের মত কবর দেয়।পাকিস্তানিদের একাধিক আক্রমণে নবীনগরের আলিয়াবাদ,সেমন্তঘর, গোপালপুর, বিদ্যাকূট, গোয়ালী, খাড়ঘর, লক্ষ্মীপুর, দক্ষিণ মুল্লা,খাজানগরসহ বিভিন্ন এলাকা ধ্বংস যজ্ঞে পরিনত হয়। বড়াইল ইউনিয়নের খাড়ঘরে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মৃতি-৭১’,
➤খারঘর গণকবর স্মৃতিসৌধ ৭১
১০ অক্টোবর ১৯৭১,পাক হানাদার বাহিনী নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের খারঘর গ্রামে নির্বিচারে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি নবীনগরের জন্য সবচাইতে আলোচিত ঘটনা। গণহত্যায় ঘটনাস্থলে ৪৩ জন গ্রামবাসী শহিদ হন। নিহতের মধ্যে ২৩ জনকে খারঘর গ্রামেই গণকবর দেওয়া হয়। বাকীদের পার্শ্ববর্তী নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে কবর দেওয়া হয়। ঐদিন নির্যাতনের শিকার হয়ে আহত হয়েছিলেন ১শ ২৭জন। ‘এর আগে স্থানীয় রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের হামলায় ‘৭১-এর ২৪ এপ্রিল বড়াইল বাজারসংলগ্ন হিন্দু বাড়ির ৮ পুরুষ নিহত ও এক হিন্দু নারীর সম্ভ্রমহানিও করা হয়।’ [২] ঐতিহাসিক ১০ অক্টোবর ও সেদিনের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯১৮ সালে সাদা মার্বেল পাথরের উপরে ৪৩ জন শহিদের নামাঙ্কিত,প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান মনির নকশাকৃত লাল রঙের ‘৭১’ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় গণকবরে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মৃতি অণির্বান’, (কনিকাড়া গ্রামের) ১২ ডিসেম্বর নিহত নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নিকটস্থ বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুস সালাম সরকারের সমাধি সহ আরো অনেক গণ কবর ছড়িয়ে আছে নবীনগরে।
নবীনগরকে মুক্ত করতে ৯ ডিসেম্বর ভোরে উত্তর দিকে নবীনগর ও আলমনগর, দক্ষিন দিক আলীয়াবাদ ও মাঝিকাড়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যুগপৎ মরনপণ আক্রমন শুরু করে।
তখন পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা নবীনগর হাই স্কুলের ছাদ, থানা ভবনের বাংকারে এবং কিছু রাজাকার জমিদার বাড়ির দোতলায় অবস্থান করে। আক্রমনের প্রথম দিনেই পাকিস্তানী সৈন্যরা মর্টার সেল নিক্ষেপ করে মাঝিকাড়ার সবগুলো কাঠের দোকান জ্বালিয়ে দেয়।
১০ ডিসেম্বর রাতে নবীনগর থেকে পাক সেনা নজর নেওয়াজ খান স্ত্রীলোকের বেশ ধরে একটি চিঠি নিয়ে হেঁটে ভৈরব যাবার পথে উত্তর দিকের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ১১ তারিখ দুপুরে আটক পাঞ্জাবী সৈন্যের হাত-পা বেঁধে সদ্য দখলকৃত থানা ভবনে আনা হয়। থানা ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে বন্দী সৈন্যটি হাইস্কুলের ছাদে বাংকারে অবস্থানরত অন্যান্য পাকিস্থানী সৈন্যদের সাথে উচ্চস্বরে আলাপ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সারেন্ডারের প্রস্তাব জানানো হলে, পাকিস্থানী সৈন্যরা অবশেষে এ প্রস্তাবে রাজী হয় এবং পরদিন (১২ তারিখ) সকাল ৭টায় আত্মসমর্পণের সংবাদ জানায়। ফলে ১১ তারিখ রাতে দু-পক্ষের গোলাগুলি বন্ধ থাকে। ঐ দিন নবীনগর হাই স্কুল ছাড়া সমগ্র নবীনগর সদর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে।
উল্লেখ্য যে, ১১ তারিখ সকাল ৯ টায় মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমান তহশিল অফিসের সামনে আংশিক মুক্ত নবীনগরের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
১২ ডিসেম্বর সকালে সারেন্ডারের ব্যাপারে পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে মতানৈক্যর সৃষ্টি হয়।একদল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অন্যদল ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণপ সম্মত, সংখ্যাগরিষ্ঠ ৩য় দলটি বঙ্গোপসাগরে অগ্রসরমান মার্কিন সপ্তম নৌ-বহর তাদেরকে উদ্ধার করবে এই প্রত্যাশায় সারেন্ডার না করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী।
১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টার নবীনগর সদরের উপর চক্কর দিতে থাকে এবং ওয়্যারলেসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দুর পাল্লার ভারী আর্টিলারী শেলিং করার নির্দেশের সংকেত প্রধান করে। সে দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হরন থেকে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলায় নবীনগর বাজারের অধিকাংশ দোকান ঘর ভস্মিভূত হয়ে যায় ও নবীনগর জমিদার বাড়ির দেয়াল ও বর্তমান উপজেলা প্রকৌশল অফিসের পূর্ব দেয়ালটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
সেদিন থেকে নবীনগর হাই স্কুলে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে সমগ্র নবীনগর শত্রু মুক্ত হয়। ঐদিন উল্লসিত সাধারন মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে নবীনগর সদরে ঢুকতে থাকে। অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী নবীনগর আসার পর অবরুদ্ধ ১৫ পাকসেনা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন গবেষক ও গণপূর্ত বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ের তালিকামতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এ পর্যন্ত ৩৫টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। গণকবর রয়েছে ১৮০টি। জেলায় গণহত্যা হয়েছে ৩৪৩টি। (তবে একজন গবেষক বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বধ্যভূমির সংখ্যা ৪২টি।) ৩৫টি বধ্যভূমির মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে ৯টি,আখাউড়ায় ৫টি, আশুগঞ্জে ৪টি, সরাইলে ৪টি, কসবায় ৪টি, নবীনগরে ৪টি বাঞ্ছারামপুরে ৪টি ও নাসিরনগর উপজেলায় ১টি বধ্যভূমি রয়েছে।
সংগঠিত হওয়া ৩৪৩টি গণহত্যার মধ্যে সদরে ৭৮টি,কসবায় ৫৬টি,নাসিরনগরে ৩৯টি,নবীনগরে ৩৯টি,আখাউড়ায় ২৩টি,বাঞ্ছারামপুরে ২২টি ও বিজয়নগরে ১৯টি গণহত্যার ঘটনা ঘটে।
নবীনগর উপজেলার ৪টি বধ্যভূমি হল,(১) খাড়ঘর বধ্যভূমি, (২) নবীনগর পাইলট হাইস্কুল মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে বধ্যভূমি,(৩) ইব্রাহিমপুর বিল বধ্যভূমি এব(৪) নবীনগর থানা কম্পাউন্ডের দক্ষিণাংশে পুকুর পাড় বধ্যভূমি।
বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় আসে এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা। অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খন্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে।
➤তথ্য ঋণ:
[১]সংগ্রামের নোটবুক
[২] নবীনগরে খারঘর গণহত্যা দিবস পালিত
দৈনিক সমকাল, প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ১৯
[৩] মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া -জয়দুল হোসেন
[৪] কথোপকথন:
☆ আবু কামাল খন্দকার
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নবীনগর প্রেসক্লাব।
☆ জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন
সভাপতি, উদীচী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংসদ।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।