১৫ আগস্ট বাঙ্গালি জাতির কলঙ্কময় শোকের দিন। বাংলার আকাশ-বাতাস আর প্রকৃতিও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। কেননা পঁচাত্তরের এই দিনে আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সুবেহে সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। ১৫ আগস্ট শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী।
ইতিহাসের জঘন্যতম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৯৭৫ সালের এই কালরাতে। এ দিন গোটা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিল সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল কিছু বিপথগামী সদস্য। সেদিন রাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনে ঘাতকের নির্মম বুলেট বিদ্ধ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বুক।
অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু ঘাতকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও খুনিদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘তোরা কী চাস? আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি?’ বঙ্গবন্ধুকে দেখেও হাত কাঁপেনি খুনিদের। গুলি চালিয়েছে খুনে চাহনীতে।
সেদিন ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের, কর্নেল জামিল।
খুনিদের বুলেটে সেদিন আরও প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু খানসহ অনেকে। ওই সময় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
১৫ আগস্ট বাংলার ইতিহাসে ও বাংলাদেশের জন্য একটি কালো দিন। কেননা বাঙালি জাতির জন্য একটি শোকাহত দিন হিসেবে এ দিনটিকে পালন করা হয়। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অনেক ইতিহাস রয়েছে। এমনি এমনি এদেশটি স্বাধীনতা লাভ করেনি। অনেক প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করেছে।
১৯৭৫ সালে সেই কালোরাতে বাঙালি জাতিকে ইতিহাসে কলঙ্কিত করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যরা। তাদের হাতেই সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ তার নিজ বাড়ির সিঁড়িতে পড়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।
পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা অবিস্মরণীয়। সেদিন তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই অমর আহ্বানেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিপীড়িত কোটি বাঙালি। সেই মন্ত্রপূত ঘোষণায় বাঙালি হয়ে উঠেছিল লড়াকু এক বীরের জাতি।
আবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি শুনেছিল মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষণা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। তার আহ্বানেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। বন্দিদশায় মৃত্যুর খবর মাথায় ঝুললেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি অকুতোভয় এ মহান নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু।
দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। দেশগড়ার এই সংগ্রামে চলার পথে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার দেশের মানুষ কখনও তার ত্যাগ ও অবদানকে ভুলে যাবে না। অকৃতজ্ঞ হবে না। নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু তাই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সাধারণ বাড়িটিতেই বাস করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা একের পর এক চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কয়েকজন সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছে ওই চক্রান্তেরই বাস্তব রূপ দিতে। এরাই স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে হামলা চালায় গভীর রাতে। হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে। বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাসও। বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও ভয়ঙ্কর ওই হত্যাকাণ্ডে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা হয়েছে। এমনকি খুনিরা পুরস্কৃতও হয়েছে নানাভাবে। হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাক সরকার।
১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু মনে করতেন স্বাধীন দেশে কোন বাঙালি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না। সেজন্যই তিনি রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে নিজস্ব প্রিয় বাড়ির মন্দির ৩২ নাম্বারে থাকতেন। বাঙালি জাতিকে তার নিজস্ব অধিকার এবং স্বাধীনতা দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন তাকে হত্যা করা হয় তিনি ঘাতকদের মেশিনগান দেখেও কোন ধরনের ভয় পাননি। বরং তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেছেন, তোরা কি চাস? কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে? কিন্তু ঘাতকদের হাত তাতেও কাপেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী জাতির জন্য নানান ধরনের আন্দোলনের মুখে নিজেকে এভাবেই এগিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ ছিল তিমিরাচ্ছন্ন।
সামরিক স্বৈরশাসক, নানান ধরনের সমস্যার মুখে কাটে ১৫ বছর। এ সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। এমনকি খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। নানান ধরনের চড়াই উতরাই পার করে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে কিছুটা দায়মুক্ত করা হয়েছিল।
ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী ক্যাপ্টেন বরখাস্ত আবদুল মাজেদকে ৬ এপ্রিল ২০২০ সালে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১১ এপ্রিল রাতে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এখনো পাঁচজন আসামি পলাতক রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট তার পুরো পরিবার সহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘাতকদের হাতে হত্যা হয়েছিল। তাই ১৫ আগস্ট কে জাতীয় শোক দিবস পালন করা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই মৃত্যুতে পুরো বাংলাদেশ গভীরভাবে শোকাহত। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সকল হত্যাকারীদের বিচার কাজের জন্য আকুলভাবে আবেদন করছি। আমরা আশা করছি আমাদের দেশনেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারকার্য শেষ করবেন।
এটি শুধুমাত্র বাঙালি জাতির জন্যই একটি শোকের দিন নয় বরং পুরো পৃথিবীর জন্যই খুবই শোকাহত একটি দিন।
জাকারিয়া জাকির, নির্বাহী সম্পাদক, জনতার খবর।