বাংলা কবিতার বিদ্রোহী ও গানের বুলবুল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী আজ। দ্রোহ চেতনার পাশাপাশি আশাবাদ, দেশপ্রেম, সব ধরনের বঞ্চনা-শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ব্যক্ত করা, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনার তীব্র বিরোধিতা করা, জনমানুষের ওপর সমাজের ওপরতলার মানুষের পরিচালিত সব অন্যায় থেকে মুক্তি কামনা ইত্যাদি জনহিতকর চেতনা কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যদর্শনকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেছে।
মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা আর সমাজের সাম্য রক্ষা-নজরুলের কবিতায় প্রতিফলিত এ তিনটি প্রবণতার বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে বর্তমান প্রবন্ধে।
পৃথিবীতে কালে কালে সুযোগসন্ধানী, লোভী আর অমানবিক কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তাদের কারণেই বারবার মানবতা সংকটের মুখে পড়ে। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যুদ্ধ সংঘটিত হলে তো কথাই নেই। সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবানদের অবহেলা, নারী-শিশুর ওপর নেমে আসা অবর্ণনীয় কষ্টের কথা কেউ মনে রাখে না।
ফলে ক্রূর হাসি হেসে পাশবিক ও নির্মম মরণখেলায় মেতে ওঠে যুদ্ধবাজরা। এমন অবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। আর কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘চারদিকে এই গুন্ডা এবং বদ্মায়েসির আখড়া দিয়ে/রে অগ্রদূত, চলতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?/পারবি যেতে ভেদ ক’রে এই বক্র-পথের চক্রব্যূহ?/উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ?/আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে উড়ছে শুধু চিল-শকুনি,/এর মাঝে তুই আলোক-শিশু কোন্ অভিযান করবি, শুনি?’ (‘পথের দিশা’, ফণি-মনসা)
ধর্মের ধ্বজাধারীদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, ধর্মের চর্চাও যেন সাধারণের জন্য নয়। শুধু মোড়ল-মোল্লা আর ধর্মের ছদ্মবেশী যারা, ধর্ম যেন-বা তাদের থাকবে কুক্ষিগত। সমাজের সেই নীতিনির্ধারকদের প্রতি ক্ষুব্ধ নজরুল বলেছেন, “শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদেরে ক’রো না ক’ বীর, ভয়,-/তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারি ত নয়।/সকলের মাঝে প্রকাশ তাহার, সকলের মাঝে তিনি।/আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।” (‘ঈশ্বর’, সাম্যবাদী)
মধ্যযুগে বাঙালি কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই,/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই।’ এরও পরে লালন বলেছেন, ‘মানুষ ধরো, মানুষ ভজো, মানুষ খোঁজো, শোন বলিরে পাগল মন।’ আর নজরুল আরও স্পষ্ট করে মানবতাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্য বজায় রেখে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন অসাধারণ পঙ্ক্তিমালায়। কারণ ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। গোটা পৃথিবীকে তিনি রূপকার্থে ‘রণ-ভূম’ আখ্যা দিয়েছেন। আর প্রতিটি ধর্মের অবতারদের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখিয়ে বলেছেন, বিশ্বাসের যে জায়গা অর্থাৎ মানুষের হৃদয় হচ্ছে উত্তম জায়গা, যেখান থেকে ধর্মচর্চার বিষয়টি নির্ধারিত হয়। তাই বলেছেন :
‘‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রিশ্চান।
(‘সাম্যবাদী’, সাম্যবাদী)
ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্ম মনের অভ্যন্তরে। মনের গহিনে জন্ম নেওয়া সেই বিশ্বাস প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করুক, সেটা কবি চাননি। এ উপমহাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে দুটি ধর্মের অনুসারী, তাদের তিনি একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, বাস্তবতার নিরিখেই বলেছেন :
‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’
কবি নজরুল মনেপ্রাণে উচ্চাশা করে গেছেন, নিজ নিজ ধর্ম বিনাদ্বন্দ্বে পালিত হবে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, একজন মানব সন্তানের বড় পরিচয় সে মানুষ। সেই বিষয়টি সবচেয়ে জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন তিনি। ফলে এ উপমহাদেশে যখন রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ই বড় হতে যাচ্ছিল, গোটা বিশ্বে যখন ধর্মীয় বিভেদের কারণে হানাহানি বেড়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন :
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
(‘মানুষ’, সাম্যবাদী)
মনুষ্যসৃষ্ট নানা বিভেদরেখায় বিভক্ত এ সমাজকে দেখে যারপরনাই বিচলিত ছিলেন কবি নজরুল। এসব থেকে কায়মনোবাক্যে মুক্তি চান তিনি। সেই কারণেই তার রচিত সাহিত্যের প্রধান উপাদান হয়েছে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এর একটি কারণও রয়েছে। তার লেখালেখির শুরুটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর-গোটা বিশ্ব যখন টালমাটাল; মানুষ যখন মানবতার চরম বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কোথাও-বা সেই সুযোগে নতুন করে শুরু হয়েছে বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি। বিশ্বযুদ্ধের সেই ডামাডোলে কবি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধজীবন। ভেবেছিলেন যুদ্ধে অংশ নিয়ে মানুষের জন্য কিছু করবেন। মোহ ভাঙতে দেরি হয়নি তার। কারণ সেই যুদ্ধ ছিল যুদ্ধবাজদেরই পক্ষে আর সাধারণ মানবতার বিরুদ্ধে। ফিরেই তিনি শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। কাব্যযুদ্ধ-জীবনযুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আস্থা রাখতে না পারা নজরুল নিজের জ্ঞান-দর্শন-অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে লেখনী হাতে তুলে নিলেন; লিখলেন। সেখানে প্রতিজ্ঞা করলেন এ সমাজের খোলনলচে পালটে দেওয়ার। বাজালেন ‘অগ্নি-বীণা’। হয়ে উঠলেন আজন্ম ‘বিদ্রোহী’। বলে উঠলেন, পুরোনোকে, জীর্ণকে, প্রচলিত সমাজের গণ্ডিকে ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। সেই আহ্বান জানিয়ে তিনি নতুনের জয়ধ্বনি করতে করতে বললেন, ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?-প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন! আসছে নবীন-জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!/…কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’ (‘প্রলয়োল্লাস’, অগ্নি-বীণা)
সব বর্ণ-ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ভেদাভেদহীন-জাতপাতহীন এক উন্নত সমাজ প্রত্যাশা করেছেন কবি। ফলে চোখের সামনে যা দেখেছেন, যা কিছু তার কাছে অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তারই প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিকার চেয়েছেন। সনাতন সবকিছুর বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন। কোনো ধর্মের মধ্যে উঁচু জাত, নীচু জাত বলে এক ধরনের অলিখিত রীতি চালু ছিল তার সময়ে (হয়তো এখনো আছে)। সেই জাতের ধোয়া তুলে যারা সমাজকে বিভক্ত করতে চান, তাদের প্রতি বিষোদ্গার করেছেন কবি। সমাজের নিপীড়িত-নিগৃহীত মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়-‘আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-’(‘বিদ্রোহী’, অগ্নি-বীণা)।
সেই কবিই আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মায়ের জাত মেয়েদের যে আমরা অবমূল্যায়ন করি, সম-যোগ্যতা সত্ত্বেও তাদের আমরা সমভাবে দেখি না। কিন্তু তিনি সব ক্ষেত্রে সাম্য চান। তার মতো বাংলার আর কোনো কবি নারীদের প্রতি যুগ যুগ ধরে চলমান অসাম্যকে সামনে এভাবে আনেননি। ফলে তিনি বলতে পেরেছেন :
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
(‘নারী’, সাম্যবাদী)
শুধু তা-ই নয়, যেসব পুরুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করে, তাদের প্রতি ক্ষোভ ব্যক্ত করে একই কবিতায় বলেছেন, ‘নরককুণ্ড বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয়-জ্ঞান?/ তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।’ সব সৌন্দর্যের, সব সাফল্যের কৃতিত্ব দিতে তিনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি : ‘এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,/নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল।/তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?/অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরিতে শা-জাহান।’
বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকের স্ব স্ব সমাজে এক ধরনের প্রভাব থাকে। নজরুলে কাব্য-দর্শন আমাদের সমাজে বাংলাভাষী মানুষের কাছে কতটুকু ব্যাপৃত হতে পেরেছে? এ প্রসঙ্গে বলা চলে, বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে জাতিরাষ্ট্রের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এর পেছনে ছিল নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের মানুষ যে পঞ্চাশের দশক থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, এ দেশের ছাত্রসমাজ যে ষাটের দশকে প্রগতিশীল ধারার আন্দোলন সংঘটিত করতে পেরেছে, তাদেরই ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছিলেন-দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলেন, এসবের পেছনে অবশ্যই নজরুলের বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। আর বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিচালিত হবে বলে বাহাত্তরে বিশ্বমানের একটি সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেখানেও নজরুল-সাহিত্যের বড় প্রভাব রয়েছে।
সাহিত্য যে সমাজদর্শনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, তা নজরুলের কাব্যকবিতা বা তার সাহিত্যের অন্যান্য উপাদানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে।
‘বিদ্রোহী কবি’, ‘প্রেমের কবি’, ‘সাম্যবাদী কবি’ কিংবা ‘সর্বহারার’ কবি হিসেবে মহাকাল কাজী নজরুল ইসলামকে মনে রেখেছে তবে তিনি যে বিশ্ব বেদনার কবি- এটাও সত্য আজকের পাঠকের কাছে। তাছাড়া কালের কণ্ঠে যে গানের মালা তিনি পরিয়েছেন, সে মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর তৎকালীন সমাজ রাজনীতির বহির্জাগতিক ঘটনার অভিঘাতে সন্দ্বীপিত হয়ে আত্মপ্রকাশের অভীপ্সায় কাব্যসৃজন করেছেন। এজন্য তিরিশের কবিদের চেয়ে তিনি ছিলেন ভিন্নতর ধারার। তবু তিনি নানাভাবে আলোড়িত করেছিলেন তিরিশের কবিদের। বস্তুত শোষণ-বঞ্চিত ও সাম্প্রদায়িক সমাজ জীবনে নজরুলের কবিতা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বে মানুষের দুঃখ-বেদনার সান্ত্বনা হিসেবে আরো বেশি প্রয়োজনীয়।
—আদিত্ব্য কামাল,বার্তা সম্পাদক জনতার খবর