‘ভোর হলো/দোর খোল/খুকুমণি ওঠ রে!/ঐ ডাকে/জুঁই-শাখে/ফুল-খুকী ছোট রে!’ [ভোর হলো]
‘থাকব না কো বন্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে-/কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।/দেশ হতে দেশ দেশান্তরে/ছুটছে তারা কেমন করে,/কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,/কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।’[ পণ]
“আমি হব সকাল বেলার পাখি।/সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।[আমি হব]
‘ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!/সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল-/ঝিঙে ফুল।’ [ঝিঙে ফুল]
‘বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল-কুকুরে/সে কি বাস করলে তাড়া,/বলি থাম একটু দাঁড়া।’ [লিচুচোর]
‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?/
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি লেবু? লাউ?/বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?’-[খুকী ও কাঠবিড়ালি]
কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা উপরোক্ত কবিতাগুলো কতশত বার পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই।
কবির ‘আমি হব’ এবং ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’ ছড়া আবৃত্তি করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনে বহু পুরস্কারও পেয়েছি। স্কুল কলেজ জীবন শেষে, চাকুরি জীবনের আধা যুগ পরে সাহিত্য পাড়ার আড্ডায় একদিন শুনলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেদিন মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে তিনি আমাদের জাতীয় কবি নন? বইয়ের পাতায় লেখা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল -শাপলা, জাতীয় ফল? – কাঠাল, জাতীয় কবি? – কাজী নজরুল ইসলাম। এসবের সবই কি ভুল? পুরো শিক্ষা জীবন, দেশে কিংবা বিদেশে নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করার পূর্বে আমি বলতাম,”আবৃত্তি করছি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা -‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’/ ‘বিদ্রোহী’….. ইত্যাদি। সাহিত্য চর্চা করেন এমন অনেকের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে সঠিকটা জানার চেষ্টা করলাম। সাহিত্যের বিন্দু বিসর্গ বোঝেন, নজরুল জীবনের অনেক কিছু জানেন এমন অনেকের কাছে উক্ত বিষয়ের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। সম্ভবত ২০০৬ সালে ঢাকায় একুশে বইমেলা চলাকালীন নজরুল ইন্সটিটিউটে গেলাম। ওখানকার একজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম যে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হওয়ার বিষয়টি এখনও মৌখিক, কোনো গেজেটভূক্ত নয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ ও বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো দলিল পাওয়া যায়নি।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ‘৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। লাল সবুজের পতাকাবাহী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে যে মহানায়কের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নিখিল বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিকে সারাক্ষণ উজ্জীবিত করে রেখেছিল। তিনি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য জীবনে কলকাতাই ছিল মূলত কবির কর্মস্থল। তবে কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, সিলেটে এসেছিলেন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। বাঙালির জয় হোক বলে যে মুক্তির কথা কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই সাধকেই পরিপূর্ণতা দিলেন জয়বাংলা বলে। ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিম বঙ্গের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে বলেন,
“…বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন দেশের শোষন পীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন করেছেন, কারাবরণ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ঠিক তেমনি নজরুলও শোষিত বঞ্চিত মানুষের কথা লেখনীর মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন- আর এই কারণেই কারাবরণ করতে হয়েছে। তাই একদিকে বাংলা সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তেমনি অন্যদিকে রাজনীতির কবি শেখ মুজিবুর রহমান।”
বাংলার আকাশে, বাঙালির চেতনা ও মননে, স্বাধীনতার অগ্নি পুরুষ, নজরুল ইসলাম ও শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্তি, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ৫০বছর পূর্তি এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী সৃষ্টি বিদ্রোহী কবিতা রচনার শতবর্ষ পূর্তি সব মিলিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশীরা যখন উজ্জীবিত এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট ভুক্তির বিষয়টি আবারো সরব হয়েছে।
‘আজ বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার একটি লেখা পড়ে কলকাতাস্থ চুরুলিয়া নব কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, নজরুল গবেষক ও নজরুলের গান কবিতার ইংরেজি অনুবাদক গিয়াস উদ্দিন দালাল আমারকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, “১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে কলকাতার এ্যালবার্ট হলে গণসংবর্ধনার সাথে নজরুলকে বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণাপত্র ও তার দলিল আমরা দেখেছি।
নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণাপত্র/সরকারী নোটিফিকেশন/গেজেটিয়ার নিশ্চয়ই ঐ দেশের নাগরিক হিসেবে আপনারা দেখেছেন।
পশ্চিম বঙ্গের এক অজ পাড়াগাঁয়ের কবির অন্য দেশের এই অসামান্য স্বীকৃতি পত্র চোখে দেখে ধন্য হতে চাই। যদি সাহায্য করেন শাহনূর ভাই।”
নজরুল সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে,নজরুলের গান কবিতা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে, একজন নজরুল অনুবাদক হিসেবে জনাব গিয়াস উদ্দিন দালালের অনুসন্ধিৎসু মন এতটুকু তথ্য জানার অধিকার রাখে বৈকি।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও গবেষক।