কবি নজরুল ইসলাম এর কবিতায় সাম্যবাদ, বিদ্রোহচিত্র ও প্রেম -আমির হোসেন

সাহিত্য, 25 August 2023, 474 বার পড়া হয়েছে,

একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে যে মানুষটি সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এক সময় ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন তিনি। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী ও ভাঙার গানের মতো কবিতা। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান লিখেছেন এবং সেগুলি সুরারোপ করেছেন। যেগুলি এখন নজরুল সঙ্গীত বা নজরুল গীতি নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা‘র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
স্বদেশপ্রেমের, জাগরণের ও উজ্জীবনের কবি নজরুল। রচনাও করেছেন দুনিয়ার সব মজদুর ও সর্বহারাকে নিয়ে কবিতা, গান। কৃষক, শ্রমিক, জেলে, কুলি, মজুর,
ছাত্রজনতা সবাইকে নিয়ে লিখেছেন প্রেমের, বিরহের, প্রকৃতির, ঋতুবৈচিত্রের কবিতা, গান। তাঁর রচনায় নানা ভাবের গান, লোকসংগীত, ইসলামী গানগুলির মধ্যে আছে গজল, হামদ-নাত জাতীয় প্রশস্তিগীতি ও নিবেদনের সুর; আছে ভক্তিমূলক গান যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণবীয় ভাবকীর্তন এবং শক্তিগান যা সংখ্যায় অজস্র।

কবি নজরুল ইসলাম ভালোবাসতেন মানুষকে। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই নহে কিছু মহিয়ান। কবি বিশ্বাস করতেন মানুষ তার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। জীবন সুখী হোক, সুন্দর হোক, আনন্দময় হোক-এই ছিল তাঁর কামনা। তার সমস্ত কবি জীবনের সদাজাগ্রত সবচেয়ে দীপ্তপ্রেরণার উৎস ছিল শোষণহীন, পীড়নহীন সমাজ। যে সমাজের ন্যায্য প্রতিনিধি মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ। মানুষের ভেতরই তিনি সন্ধান করেছেন সত্য ও সুন্দরের। তাঁর মানুষ কবিতার কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি-তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার/তোমার হৃদয়
বিশ^দেউল/ সকল দেবতার/কেন খুঁজে ফেরো দেবতা ঠাকুর/মৃত পুথি কঙ্কালে?/হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার/নিভৃত অন্তরালে।/ বন্ধু বলিনি ঝুট/ এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে/ সকল রাজমুকুট।/ এই হৃদয়ই যেন নীলাচন, কাশী,
মথুরা, বৃন্দাবন/বুদ্ধগয়া এ জেরুজালেম এ / মদিনা কাবাভবন/ মসজিদ এই মন্দিও এই/গীর্জা এই হৃদয়/এই খানে ঈশা মুছা পেল/ সত্যের পরিচয়।

মূলত তিনি চেয়েছিলেন, বৃহৎ সমাজের ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়কে পৃথক দৃষ্টিতে না দেখে সম্প্রীতির মিষ্টি বাঁধনে বাঁধতে পারলে সমাজ সুন্দর হয়, চির শান্তির বাতাবরণ রচিত হয়। এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই কবি লেখেন-
‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তার প্রাণ।’ তিনি ভগবান ও আল্লাহকে একই বুকে ধারণ করে বুঝাতে চেয়েছেন ভগবান- আল্লায় কোন বিভেদ নেই। রাম আর রহিম জোড়া দুটি ভাই। তাই তিনি লেখেন- ‘আমাদের সব লোকে বাসিবে ভালো আমরাও সকলেরে বাসিব ভালো, রবে না হিংসা-দ্বেষ, দেহ ও মনের ক্লেশ মাটির পৃথিবী হবে স্বর্গ সমান।

নজরুল কোনদিন হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায়কে আলাদা বা বিভেদের দৃষ্টিতে দেখেননি। তাই তিনি লেখেন-
‘হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই
এক বৃন্তে দুটি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই।
যাঁর সৃষ্টি মুসলিম রে ভাই-হিন্দু সৃষ্টি তাঁরই
মোরা বিবাদ করে খোদার উপর করি যে খোদকারই।’ কিংবা- ‘দুই জাতি ভাই সমান মরে মড়ক এলে দেশে বন্যাতে দুই ভাই-এর কুটীর সমানে যায় ভেসে।’

নজরুল যেমন তাঁর লেখায় প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনি তিনি দেশের দারিদ্র্য, লাঞ্চনা, বঞ্চনা ও পীড়নকে তুলে ধরেছেন। এবং এর মাধ্যমে দেশবাসীর দেশাত্মবোধের চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। সম্প্রীতির এ বাঁধন সৃষ্টি এবং দেশবাসীর চেতনাকে জাগ্রত করতে গিয়ে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে, হাজার ঝড়ঝঞ্ঝা, আঘাত-ব্যঘাত, বাধা ও বিপত্তি। কিন্তু তিনি কর্মে ও আদর্শে ছিলেন অবিচল। কোন অশুভ শক্তিই তাঁকে তাঁর কর্তব্যসত্য পথ থেকে সরাতে পারেনি। ধর্মের দোহাই দিয়ে শাস্ত্রবিদের বিভেদপন্থা নীতি সমাজ ও সমাজের মানুষকে যে পঙ্গু করে তোলে এ সারসত্য মর্মে মর্মে অনুধাবন করেছিলেন সাম্যবাদের কবি নজরুল ইসলাম। অসাম্যের ধ্বজা ধরে সাম্প্রদায়ের বিভেদবীজ রোপন করার যে নীতিহীন নীতি সমাজে ছড়িয়ে দেবার অপচেষ্টা, তাকে কাঠোর হাতে দমন করতে হবে প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষকে। এ কথার সারবত্তা উপলদ্ধি করেই তিনি লেখেন-
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কেও মহীয়ান।
নাই দেশ কাল-পাত্রে ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশ, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’

মন্দিরের পুরোহিত এবং মসজিদের মোল্লাদের যে হৃদয়হীন অমানবিক চিত্র তার প্রতিও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। ক্ষুধায় কাতর পথে পথে ভুখা মানুষের সারি। মন্দিরের পূজা আরতির সাথে প্রসাদ অন্নের ছড়াছড়ি। তথাপি ক্ষুধিত মানুষ তার এক ফোঁটাও নিজেদের ভোগে পায় না। অসাম্যের বেদিতলে ক্ষুধিত মানুষ খিদের জ¦ালায় ফট্ধসঢ়;ফট্ধসঢ়; করে। তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র করুণার দৃষ্টি ফেরে না নিষ্ঠুর পুরোহিতের। পথিক ভিখারী ভিক্ষার অন্ন চাইতে গেলে মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়। ব্যর্থ মনোরথে ভিখারি মন্দির প্রান্তে দাঁড়িয়ে ঈশ^রের কাছে অভিযোগ জানিয়ে রোদনভার কন্ঠে বলে-‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়।’ এই যে অসাম্যের বাতাবরণ, যেখানে হৃদয়পূর্ণ ভালোবাসার পরিবর্তে আছে শুধু অবজ্ঞা-অবহেলা। কবি এই অসাম্যের মানসিকতাকে বারে বারে ধিক্কার জানিয়েছেন। অনুরূপভাবে মসজিদের চিত্রটিও কবি সযতেœ তুলে ধরেছেন। সেখানে অঢেল মাংস রুটি শিরণি উদ্বুত্ত থাকে। মুসাফির খিদের জ¦ালা নিবৃত্তির জন্য মসজিদ প্রান্তে উপস্থিত হয়ে তার ভূখা থাকার কথা জানালেও মোল্লা সাহেবের হৃদয় গলে না। পরিবর্তে বেশ কিছু গালাগালি দিয়ে মোল্লা বলে- ভ্যালা হল দেখি লেঠা, ভূখা আছ, মরগে ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস ব্যাটা? ভূখারী কহিল, ‘না বাবা’। মোল্লা হাঁকিল ‘তাহলে শালা, সোজা পথ দেখ, গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা।’

এহেন হৃদয়হীন মানসিকতার পুরোহিত মোল্লাদের অমানবিক ব্যবহারে রুষ্ট হয়ে কবি লেখেন-
‘মানুষেরে ঘৃণা করি’ ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি। ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে, যাহা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে পূজিছে গ্রন্থ ভÐের দল!-মূর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’

সাম্প্রদায়িক শক্তি, সা¤্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে অবস্থান করে যেমন কবি সাম্যের গান গেয়েছেন। তেমনি নারী-পুরুষের সমতার জন্য তিনি গেয়েছেন সমঅধিকার ও সাম্যের গান। তিনি লেখেছেন-
‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশে^ যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা মূলত বিচ্ছুরিত হয়েছিল নিপীড়ন, দাসত্বম সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ উপনিবেশকতাবাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ। মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে যারা জীবনকে দুঃখময় করতে চায় তাদের চরম বিষেদাগার ও হুসিয়ারী নজরুল চেতনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। সমস্ত শোষকের বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চারণ ছিল-
‘প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায়
তেত্রিশ কোটি মানুষের মুখের গ্রাস
আমার বুকের রক্ত লিখায় যেন
লিখা হয় তাদের সর্বনাশ।’

কাব্য বিচারে ‘বিদ্রোহী’র মূল্য সকলের কাছে সমান না হতে পারে, কিন্তু তদানীন্তন যুগ-মানস যে প্রথম এ কবিতার মধ্যে-ই প্রতিবিম্বিত, এ কথা কেউ বোধহয় অস্বীকার করবেন না। এ কবিতার বিশৃঙ্খল ছন্দ ও উগ্র উৎকট উপমা উৎপ্রেক্ষাও যেন সে যুগের অন্তরলোকের নিরুদ্ধ বাস্পবেগের দ্বারা উৎক্ষিপ্ত। বিদ্রোহী কবিতার মধ্য দিয়েই নজরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর সমস্ত জীবন ও
কাব্য-সাধনার মধ্যে বিদ্রোহের প্রেরণাই প্রধান হলেও শুধু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁকে চিনতে চাইলে তাঁর প্রতি একান্ত অবিচার করা হবে বলে মনে হয়। নজরুল ইসলাম চির-বিদ্রোহী সত্য কিন্তু সে বিদ্রোহের আসল পরিচয় উগ্রচ্ছে¡াসে নয়। সমস্ত উদ্দাম তরঙ্গ-আন্দোলনের ঊর্ধ্বে তুষার শিখরের মতো স্থির। তাই বলতে হয় আপত্তির বেশি কিছু থাকত না যদি এই বিদ্রোহী খেতাবে নজরুল ইসলামের কবি-সত্তার বেশ খÐিত ও কিছুটা অপ্রাকৃতি ধারনা প্রশ্রয় না পেত।

নজরুল ইসলামকে জীবনে ও কাব্যে বিদ্রোহী বললে একেবারে ভুল হয় না কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপটা সুস্পষ্টভাবে না বুঝলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। যেমন-আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল/আমি দলে যাই যত বন্ধন/ যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল/ আমি মানি নাকো কোন আইন/আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি/আমি
টর্পেডো/আমি ভীম ভাসমান মাইন। এর সাথে আত্মবিরোধী ও বেসুর- আমি গোপন পিয়ার চকিত চাহনি/ছল করে দেখা অনুখন/ আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তার/ কাঁকন চুড়ির কনকন/আমি চির শিশু চির-কিশোর/আমি-যৌবন ভীতু পল্লী বালার/আঁচর, কাঁচলি নিচোর। মিলিয়ে যে বিদ্রোহ আস্ফালিত তার উৎমূল গভীর কিনা সন্দেহ জাগা অস্বাভাবিক নয়। নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবি সত্তার যথার্থ রহস্য এ কবিতা থেকে উদ্ধার করাও কঠিন। নজারুলের বিদ্রোহের মন্ত্রতো ‘না’ হয় হ্যাঁ। সর্বকালের সত্যিকার সংস্কারক বিপ্লবীর মতো তাঁর কন্ঠের ভাঙবার ডাকটাই বেশি করে তাদের কানে বাজে, কি-সমাজে, রাষ্ট্রে ও জীবনে জরা জর্জের ভাঙাচোরার সঙ্গেই যারা আপোষ করে থাকে তাদের। মানুষের জীবন ও জগৎ সন্বন্ধে ধ্রæব ধারনার ভিত্তি বলিষ্ঠ বাহুতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেই সেই উৎক্ষেপে তাঁর চারিধারে ভেঙে ধ্বসে পড়া কপটতা অন্ধতা ও মিথ্যার স্তুপ তাঁকে নিরর্থক ধ্বংসলোলুপতার চেহারা দিয়েছে। তাঁর বিদ্রোহী কবি-সত্তার যথার্থ পরিচয়ের যে ইঙ্গিতটুকু মাত্র পাই- মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল/ আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপান/ভীম রণভূমে রণিবেনা বিদ্রোহী রণক্লান্ত।

যা-ই হোক, কবি নজরুল ইসলামের কথা বললেই আমাদের তার প্রতিবাদী কবিতার কথা মাথায় আসে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর প্রেমের কবিতাগুলিও আমাদের মনের মাঝে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। যেসব কবিতা বাঙালির অন্তরের গভীরে বৃহৎ স্থান গ্রহণ করে আছে। তার প্রায় সমস্ত কবিতাগুলি আমাদের কাছে প্রিয়। তাঁর প্রেমের কবিতা-আমার পিয়াল বনের শ্যামল পিয়ার/ওই বাজে গো বিদায় বাঁশি,/ পথ-ঘুরানো সুর হেনে সে আবার/ হাসে নিদয় হাসি।/পথিক বলে পথের গেহ/ বিলিয়েছিল একটু স্নেহ,/ তাই দেখে তার ঈর্ষাভরা কান্নাতে/ চোখ গেল ভাসি। যৌবনে কবি প্রেমে পড়েছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন; প্রেম প্রতিটি মানুষের জীবনে অনিবার্য অনুষঙ্গ, কবি লেখকের জীবনে তো অনিবার্যভাবেই তা স্বীকৃত। প্রেম বহুধা ধারায় বিভক্ত একটি প্রিয় অনুষঙ্গ। প্রেম শব্দটি মানব জীবনে বহুমুখী ধারায় বিভক্ত একটি জনপ্রিয় শব্দ। সেটা হতে পারে মানব-মানবীর প্রেম, বাবা-ম্#া৩৯;র প্রতি প্রেম, দেশাত্ববোধক প্রেম, প্রকৃতি প্রেম ও ঈশ্বর প্রেম ইত্যাদি। প্রেম-দ্রোহ ও সাম্যের কবি নজরুলও এর ব্যতিক্রম নয়। কবিরা যেমন তাদের লেখার মাধ্যমে প্রেমের সর্বোরূপে প্রকাশ ঘটাতে পারেন। অন্যেরা তা পারেন না। এখানেই কবির সাথে অন্যদের পার্থক্য। এজন্যই কবি সমাজের অগ্রসর বা অগ্রগণ্য মানুষ। কবিরা দ্রষ্টা, সাধারণেরা যা ভাষায় শিল্পীতভাবে প্রকাশ করতে পারে না, কবিরা সেটা পারেন।

প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দোলনচাপা কাব্যগ্রন্থে তোমার কাছে সমর্পণ কবিতায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন বারবার। তিনি বিদ্রোহী ও প্রেমিক কবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট হয়ে আছেন তাঁর বিদ্রোহ ও প্রেম উভয়কে নিয়েই। নজরুল নিজেই তার কবিতায় বলেছেন, “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণতুর্য। ্য়ঁড়ঃ; নজরুলের কাব্যগুলোরও দ্#ু৩৯;টি পর্যায় রয়েছে বিদ্রোহ ও প্রেম। একদিকে আছে তাঁর অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, প্রলয় শিখা ইত্যাদি। অন্যদিকে আছে দোলন চাঁপা, চক্রবাক, ছায়ানট, পুবের হাওয়া ইত্যাদি।

বিদ্রোহী কবি হিসেবে নজরুলের কবিতায় যে নতুনত্ব আমরা পাই প্রেমের ক্ষেত্রে তা পাই না একথা অনস্বীকার্য। প্রেমিক কবি নজরুলের সঙ্গে বাংলা কাব্যের হাজার বছরের গীতি ধর্মিতা একটি অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে।

প্রেম মানব জীবনের একটি মৌলিক ও প্রবল অনুভতি বলে নজরুল কাব্যে বিদ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অবস্থান। মানুষের আর অনুভূতির ন্যায় প্রেম জটিল পরস্পর বিরোধী। প্রেমের মহিমান্বিত স্পর্শে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, আবার প্রেমের বেদনা মানুষকে রিক্ততার অর্তনান্ততায় নিক্ষেপ করে। প্রেমের প্রকাশও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। নজরুলের প্রেমে মূলত বিরহই প্রাধান্য পেয়েছে সবসময়। নজরুল তাঁর কাব্যে প্রিয়াকে দেখেছেন হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে। তাঁর কাব্যে মানবিক ও শৈল্পিক অভিব্যক্তি লাভ করেছে নিসর্গের চেতনার সঙ্গে কবির প্রেমানুভূতির অভিন্ন উপলব্ধিতে। নজরুল প্রেমের কবি হিসাবে বাংলা রোমান্টিক গীতি কাব্য ধারায় অমর হয়ে আছেন। কবি বিরহকে কবি সত্তার মৌল ব্রত, পরম প্রেরণা হিসেবে আবিষ্কার করেছেন। তিনি সব হারালেও হৃদয় হতে তাঁর প্রেমকে, প্রিয়াকে হারাতে চাননি। তাই প্রিয়া তাঁর নিত্যকালের। প্রিয়ার কাছ থেকে প্রেম না পেলেও বলেছে- ্য়ঁড়ঃ;নাই বা পেলাম কণ্ঠে আমার তোমার কণ্ঠ হার/তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংর্কায়ঁড়ঃ;।

অতএব কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আমরা যেমন সাম্যবাদ ও বিদ্রোহচিত্র দেখতে পাই তেমনি প্রেমচিত্রও মূর্ত হতে দেখি। যা বাঙালির হৃদয় মানসে সাম্যবাদ ও বিদ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অমীয় সুধা বর্ষণ করে যাবে যুগ যুগ ধরে।

আমির হোসেন, কথাসাহিত্যিক
সম্পাদক-সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘স্বদেশ’
চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার, শিমরাইলকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
মোবাইল: ০১৮১৮০৩১৫৩২