ফেসবুকে অবমাননাকর পোস্ট: সেই পরিতোষ সরকার গ্রেফতার

সারাদেশ, 18 October 2021, 387 বার পড়া হয়েছে,
নিজস্ব প্রতিবেদক : কিশোর পরিতোষ সরকারের ফেসবুকে একটি ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতভর রংপুরের পীরগঞ্জে মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সেই কিশোর পরিতোষ সরকারকে সোমবার রাতে সীমান্ত জেলা জয়পুরহাট থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার রাতে সীমান্ত জেলা জয়পুরহাট থেকে কিশোর পরিতোষ সরকারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সেখানে আত্মীয়ের বাড়িতে পরিবারসহ পালিয়ে ছিলেন পরিতোষ।

উস্কানিমূলক ছবি পোস্ট করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতভর রংপুরের পীরগঞ্জে মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে।

ঘটনাস্থল রংপুরে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের উত্তর করিমপুর কসবা মাঝিপাড়াসহ আশপাশ গ্রামগুলোতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মোতায়েন করে সেখানে চিরুনি তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

এদিকে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের মাঝে খাবার, পরিধেয় বস্ত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, ফেসবুকে অবমাননাকর পোস্টটি দেয় রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের প্রসেনজিত সরকারের ছেলে পরিতোষ সরকার। ঘটনাটি পীরগঞ্জ থানায় জানিয়ে পরিতোষকে গ্রেফতারের দাবি করে স্থানীয়রা।

এনিয়ে রোববার বিকেল থেকে উত্তেজনা চলছিল ওই এলাকায়। থানা পুলিশ সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পৌর মেয়র, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ পরিতোষের বাড়িতে অবস্থান নেয়। বিক্ষুব্ধ জনতাও ঘিরে ফেলে বাড়ি। এর আগেই সপরিবারে পালিয়ে যায় পরিতোষ। রাত ৯টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত তার বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দুরে করিমপুর-কসবা-মাঝিপাড়া এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ির সামনে এবং রাস্তার ধারের অনেক খড়ের গাঁদায়ও ১৮টি ঘর ও একটি দোকানে দেয়া হয় আগুন।

আগুনে পুড়ে যায় সুমতি রানীর গরু, প্রদীপ চন্দ্রের ভ্যানসহ থাকার ঘর। পুড়ে ছাই হয়ে যায় নিখিলের দোকান। অনেক বাড়িতে চালানো হয় ভাংচুর। লুটকরা হয় গরু, ঘরের আসবাবপত্রসহ মালামাল। আতংকে নারী ও পুরুষ অনেকেই আশ্রয় নেন পাশের ধানক্ষেতসহ বিভিন্ন জায়গায়। ভাংচুর করা হয় মন্দিরের প্রতিমা।

ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। রাত ১টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে রাতভর উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ। আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সকালে ও দুপুরে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য। এছাড়াও এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

রংপুর পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, পরিতোষ সরকার নামের ১৫-১৬ বছরের ছেলে ফেসবুকে একটি অত্যন্ত বাজে স্ট্যাটাস পোস্ট দিয়েছিল। সেই পোস্টটিকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যার পরপর অসংখ্য লোকজন উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং পরিতোষের বাড়ি আক্রমণের জন্য সমবেত হতে থাকে। এই খবর পাওয়া মাত্রই ওসির নেতৃত্বে পুলিশ ফোর্স এবং ইউএনও এর নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসনের লোকজন সেখানে আসে। আমরা খবর পেয়ে আমরা অতিরিক্ত ফোর্স পাঠিয়েছি এবং ডিসি সাহেব খবর পেয়ে ডিসি সাহেবসহ অন্যান্যরা এসেছেন। তখন আমরা সবাই মিলে পরিতোষের বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। মুল আক্রমণের স্থল পরিতোষের বাড়ি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি। কিন্তু পরের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে এ হামলা-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যারা এ ঘটনায় জড়িত আমরা কিছু নাম পেয়েছি, প্রায় ৪০ জনের মতো আটক করেছি। তারা এসে আশেপাশের গ্রামে বিনা উস্কানিতে কিছু মানুষের বাড়িঘরে হামলা চালায়, গবাদিপশু লুটপাট করেছে অগ্নিসংযোগ করেছে, বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে। মন্দিরে প্রতিমাও ভাঙচুর করেছে। এতে প্রায় ৩০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি পরিতোষের বাড়ি থেকে  এক কিলোমিটার দুরে। এতে বোঝা যায় এটি একেবারেই সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এটা করেছে। পুলিশ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রানী রায় জানান, রোববার রাতে বটেরবাজার মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরও সময় লাগবে।

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলছেন, নাশকতাকারীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ রাত থেকে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুপুর পর্যন্ত ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছি। পুলিশি অভিযান চলছে। যতদিন এই এলাকায় শান্তি ফিরে না আসবে তত দিন ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে জানান রংপুর বিভাগের এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব ভুঞা জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসনসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। আমারা চাই এখানকার মানুষ একে অপরের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করুক। যারা দোষী তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান এই কর্মকর্তা।