গাজী-কালুর কথা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জনশ্রুতি আছে, গাজী কালুর আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘে ও কুমির একঘাটে জল খেত! গাজী কালু এমনই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দু ধর্মবলম্বলীরা বনদূর্গার বদলে যাদের পূজা করে তাদের মধ্যে গাজী-কালু অন্যতম। গাজী-কালুকে নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত রয়েছে । গাজী পীর লোকজ দেবতা হিসেবে পূজিত হন। হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢোকার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি, আতপচালের শিরণি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ মানুষ জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখি কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকেন।এককালে গাজী তাঁর দুর্জয় শক্তিদ্বারা এমন অভাবনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন যে, সমগ্র দেশ গাজীময় হয়ে উঠেছিল। এদেশের বিভিন্ন স্থানে গাজীর দরগা, হাজীর আস্থানা ও গাজীর মাজার দেখা যায়। বহু স্থানের নামকরণও গাজীর নামানুসারে হয়েছে : যেমন – গাজীরহাট, গাজীপুর, গাজীরজঙ্গল (রাস্তা), গাজীরবাজার, গাজীরখাল, হাজীরভিটা, গাজীরপাড়া, গাজীডাঙ্গা প্রভৃতি। এক সময় এতদাঞ্চলে গাজীর গীতের খুব প্রচলন ছিল। যে গাজীর নাম স্মরণ করলে বনের হিংস্র বাঘ মাথা নত করে, পানির কুমীর মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, সে গাজীর জীবন বৃত্তান্ত আজও রহস্যময় হয়ে আছে।
১৪ শতকের প্রথমার্ধের প্রতাপশালী রাজা ছিলেন রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজা।যার রাজ্য ছিলো দক্ষিণে সুন্দরবন ও পশ্চিমে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত। পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, নদীয়া, বর্ধমানের বিস্তৃত এলাকায় দাপটের সঙ্গেই জমিদারি করেছেন এই ব্রাহ্মণ। তার রাজধানী ছিলো ঝিকরগাছা সদর থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাউজানিতে। সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হিসেবে পূজিত ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায় ছিলেন এই মুকুট রায়েরই সেনাপতি।
ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের প্রতিপক্ষরূপে গাজী পীরের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল (১৬৮৪) কাব্যে। ব্যাঘ্রশঙ্কুল দক্ষিণ বঙ্গে গাজী পীরের প্রভাব বিস্তার ও মাহাত্ম্য প্রচার এ কাব্যের উপজীব্য। এতে প্রথমে তাদের মধ্যে বিরোধ ও পরে বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। এক সময় দক্ষিণ বঙ্গীয় সমাজে উভয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ও পূজা প্রচারিত হয়। রায়মঙ্গলের কাহিনী নিয়ে গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য রচনা করেন শেখ খোদা বখশ ১৭৯৮-৯৯ সালে। এতে গাজী-কালুর ফকিরবেশে দেশভ্রমণ, ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রাজার সঙ্গে গাজীর যুদ্ধ, যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, রাজকন্যা চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিবাহ, গাজী কর্তৃক প্রজাদের দুঃখ-দারিদ্র্য মোচন, পরিশেষে সকলকে নিয়ে গাজীর গৃহে প্রত্যাবর্তন ও সুখে জীবন যাপনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
গাজী, কালু ও চম্পাবতী’র পরিচয় নিয়ে রয়েছে নানান কিংবদন্তি। প্রচলিত আছে বৈরাট নগরের রাজা ছিলেন দরবেশ শাহ সিকান্দর। তারই সন্তান বরখান গাজী। আর কালু ছিলেন রাজা দরবেশ শাহ সিকান্দরের পালিত পুত্র।
কালু আর গাজীর ছিল দারুণ ভাব। যেখানেই গাজী সেখানেই কালু। গাজী পীর এর বংশ পরিচয় পুঁথিতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
গোড়া বাজা গয়েপদি, তার বেটা সমসদি
পুত্র তার সাঁই সেকান্দার, তার বেটা বড়খান গাজী
খোদাবন্দ, মুলুকের কাজী
কুলযুগে তার অবসর বাদশাই ছিড়িল বঙ্গে
কেবল ভাই কালুর সঙ্গে, নিজ নামে হইলো ফকির।
যা হোক, ঘটনাচক্রে চম্পাবতীর ভালোবাসার টানে গাজী ছুটে গিয়েছিলেন ছাপাই নগর; বর্তমানে বারোবাজার নামে পরিচিতি।
সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতী। হিন্দুরাজার মেয়ের প্রেম গাজীকে ভুলিয়ে দিল সে মুসলমান। প্রেমতো আর ধর্ম-জাত মানে না। ছাপাই নগর চলে আসার পর গাজীর সঙ্গে কালুও ছিলেন।
ছাপাই নগরের বলিহর বাওরের তমাল গাছ তলায় গাজী নিয়মিত অপেক্ষা করতেন চম্পাবতীর জন্য। এদিকে মুকুট রাজা তো রেগেমেগে আগুন। গাজীকে শায়েস্তা করতে ভার দিলেন তার সেনাপতিকে। তবে সেনাপতি দক্ষিণা রাও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গাজীর কাছে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নেন। অন্যদিকে রাজা রামচন্দ্র যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চলে যান ঝিনাইদহের বাড়িবাথান। পিছু পিছু গাজীও গেলেন। সঙ্গী হিসেবে এবার কালুর সঙ্গে দক্ষিণা রাও-ও আছেন।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত চম্পাবতীকে উদ্ধার করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসলেও বিষয়টা রাজা সিকান্দর মেনে নিতে পারলেন না। তিনি গাজীকে তার বাড়িতে উঠতে তো দিলেনই না, বিতাড়িতও করলেন।
প্রেমের জন্য দরবেশ হলেন গাজী। চম্পাবতীকে নিয়ে পথে নামলেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় গাজীর আস্তানা হয় সুন্দরবন এলাকায়। সেখানে তার সঙ্গী যথারীতি কালু ও দক্ষিণা রাও।
শহর-গ্রামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প-কাহিনী। তবে এর সত্যতা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ-ইতিহাসবিদদের অনেক মতভেদ আছে।
গাজীর আসল পরিচয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতদ্বৈততা আছে। প্রমাণ্য তথ্যের অভাবে গাজীর জন্ম-বৃত্তান্ত সস্বন্ধে এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারেননি গবেষক ও ঐতিহাসিকরা। তাঁর জীবনের নানা ঘটনা অবতারণা করে কেহ কেহ বলেন, গাজীর অভ্যুদয় ঘটে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে। যশোর জেলার ঝিকরগাছা সংলগ্ন ব্রাক্ষণনগরের রাজা মুকুটরায়ের রাজত্বকালে গাজী ইসলাম প্রচারে আবির্ভূত হন দক্ষিনবঙ্গে। আবার অনেকে মনে করেন মধ্যযুগে সুলতান রুকুনউদ্দীন বরবক শাহ্ (১৪৫৯-১৪৭৪ খৃ:) প্রধান সেনাপতি ছিলেন এ গাজী। তিনি সেনাপতি হিসাবে আসাম ও বাংলার বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক বুজুর্গ ব্যক্তি। যোদ্ধা ও দরবেশ হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি জনগণের নিকট অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ‘পীর’ বলে পরিচিত ছিলেন। ঝিনাইদহ অঞ্চলে গাজী-কালু ও চম্পাবতী সম্পর্কে নানা ধরনের জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দক্ষিণবঙ্গে খানজাহান আলীর আবির্ভাবের পূর্বে গাজীর আবির্ভাব হয় এ কথা অধিকাংশ গবেষকের ধারনা। গাজীর স্মৃতিচারণ এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোকে করে থাকে।
এ বিষয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও, ঝিনাইদহ জেলার বারোবাজারের বাদুরগাছা মৌজায় অবস্থিত গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজার সব সম্প্রদায়ের লোকের নিকট একটি পবিত্র পীঠস্থান স্বরুপ। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মনোবাসনা পূরন ও রোগ-ব্যাধি হতে নিরাময় লাভের মানসে এ মাজারে মান্নত করে ও শিন্নী দেয়। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাশে গাজী-কালু ও, চম্পবতীর মাজার বিদ্যমান । মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে কূপ কিংবা অন্য কোন কবর বলে মনে করেন। ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিন শেড তৈরী করে দিয়েছেন। গাজী কালু চম্পাবতীর সাথে দক্ষিণ রায়ের কবরও এখানে রয়েছে বলে শোনা যায়।
তথ্যসূত্র:
গাজী, কালু, চম্পাবতী’র সঙ্গে একদিন
পীর বড়খাঁ গাজী – উইকিপিডিয়া
গাজী কালু ও চম্পাবতী