‘আমাদেরও মন আছে মা,তারা বুঝবার পারে না’ –নুসরাত জেরিন

জনতার কন্ঠ, 5 December 2021, 406 বার পড়া হয়েছে,

জরি এখন বড় হয়েছে, ভালো মন্দ বুঝতে শিখছে! মানুষের সাথে,সহপাঠীদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, সামাজিকতা রক্ষা করতে হয়-এইটুকু এখন সে বুঝে। কিন্তু দারিদ্র্যতা পিছু ছাড়েই না। বাবা চালায় রিকশা আর মা করে কাজ বাসায় বাসায় আছে ছোট একটা ভাই, আছে দাদী এই নিয়েই তাদের সংসার। শহরে ভাড়া বাসা নিয়ে থাকে খুব কষ্টে। বাবার টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে, পড়াশোনা ভরনপোষণ করা খুব কষ্টসাধ্য; তাই মাকে যেতে হয় কাজে। এইদিকে জরির খুব কাছের এক বন্ধু দাওয়াত দিলো জন্মদিন উপলক্ষে, সব বন্ধুরাই গেলো কিন্তু জরি যেতে পারলো না কারণ তার কাছে ভালো জামা ছিলো না। তাছাড়া একদিন এক অনুষ্ঠানে কাপড়ের জন্য এক বন্ধু বলেই বসলো তকে নিয়ে গেলে আমাদের সবার সাথে মিলে না জরি,সেই কথা জরিকে প্রচন্ড ভাবে আঘাত করে। জরি পরিবারকে যথেষ্ট বুঝে তাই সবকিছু মা-বাবাকে বলতেও চায় না।

জরি স্কুলে যে রাস্তা দিয়ে আসা যায় করে, সে রাস্তার পাশেই বড় একটি শো-রুম আছে। সেই শো-রুমে নানা রকমের দামী কাপড়চোপড় ঝুলানো, জরি দূর থেকে প্রতিদিন দেখে আর ভাবে ইশ্ একটা জামা যদি কিনতে পারতাম। মাস দু’মাস ধরে সে শুধু তাই জল্পনা কল্পনা করে তাছাড়া বন্ধুদের কাছে ছোট হয়েছে সে কথাও ভুলতে পারে না। সে ঠিক করলো আজ মায়ের কাছে বলবেই। রাতে মায়ের পাশে শুয়েছে। মা বললো,কি করে তোর মুখটা শুকনা শুকনা লাগতাছে? কি হইছে? জরি বললো, মা স্কুলে যাওয়ার সময় একটা বড় দোকান পড়ে,সেই দোকানের জামাগুলো খুব সুন্দর। আমাদের সাথে সবাই কত সুন্দর সুন্দর জামা পরে মা, তুমি আমার একটা জামা কিনে দিবা! বাবার কাছে কইলে বাবা,খালি চিল্লাচিল্লি করে,এবার কিন্তু তুমি আমারে কিনাই দিবা। জরির মা কইলো, স্কুল ড্রেসটাই পুরান হইয়া গেছে,নতুন কইরা বানাইয়া দিবার পারি না; তুই আবার অন্য জামা চাস!তবুও বলছিস যখন সামনের শনিবার বাহিরে বাজার বসে, সেইখানেও সুন্দর সুন্দর জামা উঠে, সেখান থেকে কিনে দিবো তোর বাপরে বলে। জরি আর কিছু না বলেই ঘুমিয়ে পড়লো চুপচাপ। জরির নিরবতা দেখে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো মেয়েটা তো কিছু চায় না সহজে, কি করমু সংসারেই চালাইতে পারি না। এভাবে কয়েক মাস চলে যায় যদি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় সে দোকানের সামনে দিয়ে যায় আসে,জামা দেখেও না দেখার ভান করে।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসতে না আসতেই মা বলল চল তো জরি আমারে নিয়া যায় সেই দোকানটাতে তোরে জামা কিননা দিমু! জরির চোখে মুখে হাসি, মা মা সত্যি সত্যিই! মা বললো আমারে আগে নিয়া যা। বড় দোকানের সামনে যেতেই তাদের চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড তাদের দিকে কেমন জানি আড়চোখে তাকাল! সেই তাকানোটা জরির চোখে ভালো লাগি নি। ভেতরে প্রবেশ করলো, সবাই তাকিয়ে আছে কেমন করে জানি?তাদের পরনে ছিল সাদামাটা কাপড়। জরি জামা দেখাতে বলে, কিন্তু দোকানদার কেমন নারাজ চোখে ইতস্তত করে বললো, জামার দাম কত জানেন? জরির মা বললো কত? যতই হউক আমরা নিবো? কিন্তু দোকানদার মনে মনে বিরক্তিবোধ করে আরো বেশি। জরির মন মানসিকতা খারাপ হয়ে গেলো সে ভাবলো তারা তো মানুষেরে মানুষ মনে করে না! জরি হুট করে বললো, মা চলো জামা কিনবো না! জামাটা দূর থেকেই সুন্দর লাগছিলো, কাছে এসে দেখলাম-ওতোটা সুন্দর মনে হইতাছে না। মা জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে সুন্দর ওই তো! না,না, মা আমি এই জামা কিনবো না।
জরি বললো, মা আজ তো শনিবার চলো না ওই বাজারে যায়। মা বললো হঠাৎ করে তোর কি হলো?জরি বললো কই না তো মা! মা নিয়ে গেলো বাজারে, খোলা আকাশের নীচে গাড়িতে গাড়িতে নানা রকমের কাপড়চোপড় সাজানো। গাড়ির সামনে যেতে না যেতেই দোকানদারের মুখে হাসি,বললো আসেন আপা আপা আসেন! কি নিবেন কোনটা নিবেন? জরি মুহূর্তেই বদলে গেল দোকানদারের ডাক শুনে বললো, মামা ওই জামাটা দেনতো! কত মামা? মামা বলল, ১২০ টাকা রাখি তোমার জন্য ১০০ টাকা, ঠিক আছে মামা আমার এই জামাটা দিয়া দেন।জরির কাণ্ডকারখানা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল জরির মা।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে মা বললো, আচ্ছা!
জরি তুই কেন এমন করলি? কত আশা কইরা গেলি নামিদামি দোকানে, কাপড় কিনবি, শেষমেষ পরে এটা কি করলি তোর কি সত্যি জামাটা পছন্দ হয়েছে! জরি বললো, মা গো মা আমি আসলে কষ্ট দিচ্ছি তোমারে, আমি বুঝতে পারি নাই আমারে ক্ষমা কইরা দেও তুমি টাকা জমাইছো আমার জন্য নিজে কষ্ট কইরা সংসার চালায়ছো। তাছাড়া যেসব বন্ধুরা আমারে সত্যি বন্ধু মনে করে না,আমার কাপড়ের দিকে তাকায় থাকে,তাগো মতোন এমন বন্ধু আমার দরকার নাই আর যেই দোকানদার মানুষকে মানুষ মনে করে না’ আড়চোখে তাকায়, সেই দোকান থেকে কাপড়ও কিনবো না। আমাদেরও মন আছে মা, বড়লোকরা বুঝবার পারে না! তুমি দেখলা না মা, রাস্তায় রাস্তায় যারা কাপড় বিক্রি করে, তারা কত সুন্দর কইরা কথা কই ;শুনলেই শান্তি লাগে,তারা অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ নি কাছে আসে জিগায় সে আশায়। বড় বড় মাপের মানুষ আইসা তাগো মতোন গরিবরে ঠিকই ঠকায় আর বড় বড় শো-রুম থেকে ঠিকই দাম দিয়া কিনতে পারে। মা ভাবতে ভাবতে বললো, ঠিকই কইছোছ রে জরি। মানুষ বুঝা বড় দায়!! যেই দেশে যারা বড়লোক তারা আরো বড় হইতে চায়, গরিবরে ঠিকই ঠকায়, সেই দেশে ভালো কিছু হইবো এমন আশা করাও পাপ।

০৫-১২-২০২১ইং
ছবিঃ শনিবার, কোর্ট রোড, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।