মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ : তিতাস নদীর কোল ঘেঁষে নোঙর পাঠাগার। শহরের প্রান্তসীমানায় হওয়ায় সেখানে তেমন কোলাহল নেই। তার বদলে চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য, স্নিগ্ধ বাতাস ও শান্ত জলের কোমলতার পরশ নীরবে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শান বাঁধানো রাজঘাটে বসে চোখ তুললেই অদূরে দেখা যায় নীল-সাদা আসমান, নদীর জল আর দূরের ঘড়বাড়ি, গাছপালা একটি রেখায় মিলেমিশে একাকার। সদ্য গড়ে ওঠা দুটি ব্রিজ ও রাস্তা প্রকৃতির বুকে কিছুটা ছেদ দিলেও গোলাপের বুকে গেঁথে কাঁটার মতো তার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে না মোটেও।
ক্লান্ত দিবাকর তখন বিকেলের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে বিকেলও আবার সন্ধ্যাকে ছুঁইছুঁই করছে। ততক্ষণে সেখানে একে একে হাজির হচ্ছেন সাহিত্যপ্রেমী স্থানীয় গুণী লেখক, কবি, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ। নদী বন্ধুরা আরো আগেই সেখানে উপস্থিত ছিলো নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে।
আঁধারকাটা রুপালী জ্যোৎস্না তখনও তার নিজের উপস্থিতি জানান দেয়নি। জোনাকিদের খুঁজে পেলাম না আশে পাশে, সম্ভবত আমাদেও উপস্থিতি টেরপেয়ে রাগ করে অন্যদিকে চলে গেছে। দুটো কৃত্তিম ইলেক্ট্রিক চাঁদের আলোয় আলোকিত করা হলো সেগুন, নিম, কাঁঠাল, বেল, কৃষ্ণচূড়ার আছাদন। মৃদু বাতাস দায়িত্ব নিলো বৈদ্যুতিক পাখার।
সকলে তার মাঝখানে সারিবদ্ধ চেয়ারে বসে শুরু হলো সাহিত্য আড্ডা। জীবন-জীবিকা যেখানে সরল-গরলের সংমিশ্রণ সেই নগর সভ্যতার জাঁতাকলে পিষ্ট নানান অভিজ্ঞতার কথা তখন একে একে বের হয়ে আসছিল আমন্ত্রিত জনদের মুখ থেকে। তার সঙ্গে সাহিত্যের রূপ, রস ও তত্ত্ব মিলেমিশে তৈরি করেছে এক নিগূঢ় নান্দনিকতা। প্রচন্ড রাগে অগ্নিগিরির কুণ্ড থেকে উষ্ণতাকে সাথে নিয়ে ধীর ছন্দে বয়ে যাওয়া সদ্য নির্গত হওয়া লাভার মত যার শ্রোত। গল্পের মাধুর্যতায়, কাব্য-কবিতার ছন্দে, মৃদু হাস্যরসে, আবেগ আর আক্ষেপে সময় তখন রাতের অন্ধকারকে ক্রমেই গ্রাস করে নিচ্ছিল।
তাঁদের শব্দ, বাক্যের ফুলঝুড়িতে তখন মুগ্ধ হয়েছিল পরিশ্রান্ত পাখির ঝাঁক। ডাকতে ভুলে গিয়েছিল ঝিঁঝিঁ পোকার দল। হয়তো মায়ের ডানার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো টুনটুনির ছানাগুলো। ভাবছিলো ওরা কারা, কি বলছে এসব ! চড়ুই, কাক, ফিঙে, দোয়েল, শালিক, মাছরাঙার চোখেও তখন একরাশ তার বিস্ময়তা। উড়তে উড়তে ডানার ক্ষিপ্ততা কিছুটা কমিয়ে সেই আড্ডার সাক্ষী হয় সাদা বক সহ কিছু রাত জাগা পাখি।
আড্ডা যখন শেষ প্রান্তে খালেদা মুন্নী আপা তার মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি করলেন বৃক্ষের প্রান্ত ছুঁয়ে আবছা আলো নিয়ে জ্বলে ওঠা জ্যোৎস্না দেবীকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি ভীষণ রাগ করেছেন। হয়তো বলতে চাইছেন কি ব্যাপার ! আসতে না হয় একটু দেরি হয়েছে আমার আর তাতেই আমার বদলে দুটো নকল চাঁদ নিয়ে এসেছো। আমার মতো স্নিগ্ধ-কোমল ভালোবাসার পরশ কি পেয়েছো তাদের কাছ থেকে ?
অনেকের মোবাইল ফোনের রিংটোন তখন বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল জীবনের স্পন্দন শুধু খোলা আকাশের নিচে নয়, ইট পাথরের ছাদের নিচেও অপেক্ষায় আছে। তারওপর দুপুরের থেমে যাওয়া বৃষ্টি নামার ভয়, মাঝে মাঝে লম্বা নাকওয়ালা ছোট প্রাণীর তীক্ষè কামড়। তাই কিছুটা অপূর্ণতা রেখেই সভা শেষ করে সবাই যখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ঘড়ির কাটায় তখন ১০.১৩ কে আলিঙ্গনে ব্যস্ত। সময় ও প্রকৃতিকে মনে মনে বললাম তোমার সুন্দর স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে গেলাম বন্ধু। যেন একটু সুযোগেই বারবার ফিরে আসতে পারি।
আজকে সাহিত্য আড্ডায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিশিষ্ট কবি জনাব মোঃ আব্দুল কুদ্দুস মহোদয়। আড্ডায় মূখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জনাব জয়দুল হোসেন। বিশেষ আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট অঞ্চল), বাচিকশিল্পী জনাব মোঃ মনির হোসেন, মাসিক তিতাস বার্তার সম্পাদক এমএ মতিন শানু ভাইসহ আরো অনেকে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী সোহেল আহাদ ভাই।
সভায় আমি পাঠ করেছিলাম ২ মাস ২২ দিন বয়সী “তিতাসের আঁচল জড়ানো মায়াময় প্রকৃতি” কবিতাটি।
গতকাল সন্ধ্যায় চমৎকার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ নদী বন্ধু শামিম আহমেদ ভাই ও নোঙর পরিবারের সকলকে।