হিজরি বর্ষের নবম মাস রমজানের আগমন ঘটে প্রধানত সিয়াম ও কিয়ামের (রোজা ও তারাবির) বার্তা নিয়ে।ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম রোজা এ মাসেই পালন করা হয়।
রমজানের নামকরণ :
বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ওঁনার ‘গুণীয়াতুত ত্বালেবীন’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘রমজ্বী’ শব্দের অর্থ বর্ষার বৃষ্টি। বৃষ্টি যেরূপ যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয়, তদ্রুপ রমজান মাসও বান্দার যাবতীয় পাপ মুছে দিয়ে পবিত্র করে দেয়। যার দরুন এ মাসের নাম রাখা হয়েছে ‘রমজান’।
পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআনে রমজান ছাড়া অন্য কোন মাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি।অন্যসব মাসের চেয়ে এটি শ্রেষ্ঠ, তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: ‘শাহরু রমাদ্বা-নাল্লাযী উনযিলা ফি-হিল কুরআন’। অর্থাৎ, ‘রমজান ওই মাস, যে মাসে আমি পবিত্র কুরআন নাযিল করেছি’। ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়েত ও সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
শুধু কোরআন নয়, ইব্রাহিম (আ.)-এর সহিফা, তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিলসহ সকল আসমানি কিতাব এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে।
নবী করিম (স.) ইরশাদ করেছেন: শা’বান আমার মাস, আর রমজান হলো আল্লাহর মাস’ (মা’সাবাতা বিস্সুন্নাহ)। রমজান মাসে রোজা পালন করলে আল্লাহ তায়ালা প্রতিদান ঘোষণা করেছেন এভাবে: ‘মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকীর সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, কিন্তু রোজার ব্যাপারটা ভিন্ন। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্যই নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। (সহীহ মুসলিম-১১৫১)।
‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা আমারই জন্য রাখা হয় এবং আমিই এর প্রতিদান দেবো’। (সুনানে বায়হাকি)
‘রমজান এমন মাস, যার প্রথমাংশে আল্লাহ তাআলার রহমত বর্ষিত হয়। যার ফলে মানুষের জন্য গুনাহের গভীর অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসার এবং ইবাদত করে পবিত্র হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই মোবারক মাসের মধ্যভাগে পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয় এবং শেষাংশে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক স্থায়ী আজাব থেকে রেহাই হয়’। রমজানের শেষদিকে রয়েছে লাইলাতুল কদর, ‘লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (জিবরাঈল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্তু নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তি, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ’ (সুরা : কদর, আয়াত ৩-৫)
‘অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিন ও রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭৪৫০)।
এ মাসে শয়তানকে বেড়ি পড়ানো হয়।
‘রমজান মাসের প্রথম রজনীতে শয়তানদের মজবুতভাবে বেঁধে রাখা হয় এবং অবাধ্য জিনদেরও বন্দি করে রাখা হয়। দোযখের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো দরজা পুরো রমজান মাসে খোলা হয় না এবং জান্নাতের সব দরজা খুলে দেওয়া হয়। একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। সঙ্গে সঙ্গে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকেন, হে সাওয়াব প্রত্যাশীরা! অগ্রসর হও, এটা সাওয়াবের মোক্ষম সময়। হে পাপিষ্ঠরা! পাপ থেকে হাত গুটিয়ে নাও এবং নিজেদের গুনাহ থেকে বিরত রাখো। কেননা, এই পবিত্র সময়টা তাওবা করার ও গুনাহমুক্ত হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। এই পবিত্র মাস কেবল আল্লাহ তাআলার জন্য। আল্লাহ তাআলা এই পবিত্র মাসের সম্মানার্থে অনেক পাপিষ্ঠকে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। আর তা রমজানের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (বায়হাকি শু’আবুল ঈমান)
‘মানুষের প্রত্যেকটি আমল বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় এ মাসে। একটি নেকী ১০ গুণ থেকে (ক্ষেত্র বিশেষে) ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: কিন্তু রোজার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ রোজা আমার জন্য। সুতরাং তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব। (বুখারি, হাদিস : ১৮৯৪)
জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি বিশেষ দরজা রয়েছে, যা দিয়ে একমাত্র রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসলিম, হাদিস: ১১৫২)। আর যে ব্যক্তি সে রাইয়ান গেট দিয়ে প্রবেশ করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তি, যিনি উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম পালন করে, তার প্রথম পুরস্কার—রমজান শেষে গুনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৬৬ ] আমিন।