রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার প্রতিদিনের প্রথম পানীয় ‘চা’। চা’য়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে নিউজ ফিডের আপডেট গুলো চেক করে নেই। আমার প্রতিদিনের শুরুটা এভাবেই হয়। সকালের নাস্তার পর আরো এক কাপ চা এবং রাতে ঘুমানোর আগেও এক কাপ চা’য়ে চুমুক দিতে দিতেই প্রতিদিনের কর্মসূচি শেষ করি। সকাল থেকে রাত অব্দি আরো অনেকবার চা খাওয়া হয়।
আমাদের দেশতো বটেই বিশ্বের অনেক দেশেই যে কোন অফিসে গেলেই এক কাপ ‘চা’ দিয়ে আপ্যায়ন করা নিয়মিত শিষ্টাচারে পরিণত হয়েছে আরো অনেক আগেই। রাস্তায় হঠাৎ পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে তাকেও নিয়েও বসা হয় কোন চা’য়ের দোকানে। খোঁজখবর নিতে নিতে চুমুক দেওয়া হয় চায়ের কাপে। চা খেতে খেতে কারো সাথে গল্পে গল্পে জরুরি আলাপ সেরে নেওয়া হয়। অফিসে, অবসাদে, ক্লান্তিতে, বন্ধুদের আড্ডায়, সাহিত্য বা সংস্কৃতির অনুষ্ঠানের আগে পরেও চলে চা’য়ের আসর।
সারা দিনে ঠিক কত কাপ চা খাওয়া হয় তার হিসেব না রাখলেও আট থেকে দশ কাপ, কোনদিন তার থেকেও বেশি চা খাওয়া হয় আমার। অনেকে বলেন আমার এই চা খাওয়ার বাজে অভ্যাসের কারণেই আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি নেই। আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে বেশ ভেবেছি এবং চা না খাওয়ার কঠিন সংকল্প করেছি। কিন্তু তা পূরণ করতে পারিনি কখনই। কেউ কিছু খাওয়াতে চাইলে বলি ‘চলুন এক কাপ চা খাই।’
খ্যাতিমান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘অদ্ভুত চা খোর’ গল্প পড়েছিলাম ছোটবেলায়। গল্পের নায়কের মত সেই রকম চা-খোর না হলেও, চা খাওয়া যে আমার একটি বাজে অভ্যাস পরিণত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার চায়ের অভ্যাসের সাথে যুক্ত হয়েছে আমার শিশু কন্যা তাসফিয়া নূর ঝিলমিল। ওর পাঁচ কি ছয় মাস বছর বয়সে ওর দাদী চায়ের কাপে আঙ্গুল চুবিয়ে ওর ঠোঁটে লাগিয়ে দিয়েছিল আর ঠোঁট চুষে সেই চা’র স্বাদ আস্বাদন করা শিশু দুগ্ধ শিশুটি এখন আলাদা কাপে চা খায়। সে খুব বেশি চা না খেলেও আমার সাথে নিজেও তার মার কাছে চা’য়ের বায়না ধরবে। কখনো কখনো নিজ থেকেই আমাকে বলবে “আব্বু চা খাবে” ? আমি হ্যাঁ বলতেই মাকে জ্বালাতন করে বলবে ‘আব্বু বলেছে চা খাবে, চা বানিয়ে দাও’।
আমার নিজেরও চা খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করেছিল আমার বাবা। ছোটবেলায় আব্বার সাথে ফুলছড়ি ঘাটে যেতাম। নাস্তার পরে বাবা নিজেও চা খেতেন আর একটি পিরিচে কিছুটা চা আমাকে ঢেলে দিতেন। সেইখান থেকেই আমার চা খাওয়া শুরু। মাঝে মাঝে আম্মা বাসায় চা বানালে আমরা ভাই-বোন ভাই চা খাওয়ার সুযোগ পেতাম।
এই চা খাওয়া নিয়ে আব্বার কাছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও পেয়েছি। একদিন ভুল করে আমি আমার ছোট ভাইয়ের ভাগের চায়ের সামান্য অংশ খেয়ে ফেলেছিলাম। পরিমাণে কম হওয়ায় আমার ভাই কান্না করবে ভেবে তখন আমি আব্বাকে বললাম ‘আমি এখন এই কাপে যদি পানি মিশিয়ে দেই, তাহলে সে আর বুঝতে পারবে না আমি যে তার ভাগের চা কিছুটা খেয়ে ফেলেছি”। আব্বা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এটা কেন করবে? কাউকে কিছু দিলে ভালোটাই দিতে হবে। তা না হলে দেয়ার দরকার নেই। আমি এখনো আব্বার সেই আদেশ পালন করার চেষ্টা করি।
মাঝে মাঝে ব্রিটিশদের ধন্যবাদ জানাই শত বছর আগে আমাদের এই চা খাওয়ার অভ্যাস করার তৈরী করে যাবার জন্য। আবার তাদের প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ করি। তারা যদি আমাদের এই চা খাওয়ার অভ্যেস তেরী না করতো তাহলে হয়তো আমাদের অনেক সময় এবং টাকা বেঁচে যেত।
কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। বাঙালির জীবনে চা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেছে। অফিসে-আদালতে, সভা-সমাবেশে, গল্প-গুজবে, সাহিত্য আড্ডায়, আদর-আপ্যায়ন, সম্মান জানাতে, বিয়ের পাত্র-পাত্রী দেখতে, সব আয়োজনে চা এর উপস্থিতি থাকবেই থাকবে। চা না খেলে বক্তার গলায় এখন আওয়াজ আসে না। আড্ডা জমে না। চা না খাওয়ালে অনেকের গলায় অভিমান ঝরে পড়ে ‘বলেন ওর বাসায় /অফিসে গেলাম আমাকে এক কাপ চা’ও খাওয়ালো না। চা খাবে বলে ফ্রী ইনকাম করে বসেন অফিসের পিয়ন থেকে নিয়ে কর্মকর্তাগণ। সে ক্ষেত্রে এককাপ চা বিল ১০০ টাকা থেকে কয়েক লক্ষ টাকাও হতে পারে। এই বিল না দিলে আবার অনেক ফাইল নড়তে পারে না। অর্থাৎ অফিসের ফাইলগুলিও এখন চা খায়।
দেশে-বিদেশে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই কত বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। হয়েছে অনেক অপকর্মের ষড়যন্ত্রও। এক একটি চায়ের কাপ সাক্ষী হয়েছে কতশত আলোচনার। হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে কত আলোচনার। গ্রাম্য ঝগড়া থেকে বিশ্ব রাজনীতি, ধর্ম-সাহিত্য-সংস্কৃতি বা প্রযুক্তির কত ছোট বড় বিষয় সাক্ষী হয় এক একটি চায়ের পেয়ালা।
এই চায়ের ব্যবসা করে সংসারের হাল ধরে আছেন লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টেও আছে নামিদামি ব্র্যান্ডের চায়ের সমাবেশ। ৫০ টাকার চা খেতে এক দেড়শ টাকার মোটরসাইকেলের তেল পোড়ায় অনেক সৌখিন যুবক। সেদিন টিভিতে দেখলাম এক কম্পানী তাদের সিরামিকের বিভিন্ন পন্যের মান ও দামের কথা বলছে। তার দেয়া তথ্য সেখানে চা’ পান-পাত্রের দাম ৫০ হাজার থেকে দের লাখ টাকাও আছে। ভাবা যায়….. চায়ের কী কপাল !
এ সব কিছুই আমার বা আপনার অজানা নয়। শুধু অজানা ছিল এই চা যাদের হাত ধরে আমাদের ঠোঁট পর্যন্ত এসে পৌঁছায়, সেই শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী মাত্র ১২০ টাকা। মাস শেষে যা দাড়ায় ৩৭২০ টাকা। কোন কোন মাসে আরো কম।
গত ১৩ আগস্ট ফেসবুক জুড়ে দেশের চা শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনের ছবি ভাইরাল হতে থাকে। আমি অবাক হয়ে সেই ছবিগুলো দেখছিলাম। এই দেশে কত বড় বড় ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে থাকে খেটে খাওয়া স্বল্প আয়ের মানুষদের কত দুঃখ-সুখের গল্প। কত ফালতু ইস্যুতে সরব হয়ে যায় ফেসবুকের পাতা। এসবের ভিড়ে শত বছরেও এই চা শ্রমিকদের দিকে নজর দেয়নি দেশের বড় বড় জ্ঞানীগুণী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শ্রমিক সংগঠন বা মানবাধীকার সংগঠনগুলো। চায়ের দেশে নামিদামি রিসোর্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে কত সভা-সমাবেশ, প্রমোদ ভ্রমণ, আনন্দ আয়োজন। এসবের ভিড়ে চা শ্রমিকদের জীবন আলেখ্য আমাদের চোখের আড়ালে থেকে গিয়েছিল এতদিন।
গত পাঁচ দিন ধরেই এই চা শ্রমিকদের নিয়ে কিছু লিখব ভাবছিলাম। এর মধ্যেই রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার পরে প্রাইভেটকারের ৫ যাত্রী নিহত হওয়ার খবর ভাইরাল হতে থাকে। সেই নিউজ পড়তে পড়তেই নজরে পড়ে যে গাডার্র প্রাইভেটকারটিকে চাপা দিয়েছিল তার ওজন ১২০ টন। যার ভার নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না উত্তোলনকারী ক্রেনের। ১৫ আগস্ট বিকেলে জসিম উদ্দিন সড়কে ঘটা ১২০ টনের এই গার্ডার দুর্ঘটনা দেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। খুবই দুঃখজনক এই ঘটনার বিভিন্ন পোস্ট পড়তে পড়তে আমার মনে উঁকি দিতে থাকে এই ১২০ সংখ্যার নিচে চাপা পড়ে আছে আরো কতশত মানুষ আর তাদের পরিবারের জীবনের ট্রাজেডি।
আজকাল যতবার চা খেতে যাই তখনই মাথার মধ্যে এই ১২০ শব্দটি গেঁথে থাকে। কাকতালীয়ভাবে ২০১৩ সালে আমি যখন পৌরসভায় মাস্টাররোলে চাকরি নেই। তখনও আমারও দৈনিক মজুরী ছিল ১২০ টাকা।
১২০ সংখ্যাটি মাথার মধ্যে গেঁথেছিল গত পাঁচ দিন ধরে। ১২০ কে মাথার মধ্যে মাথা থেকে বের করতে পারছিলাম না। আবার কিছুই লিখতেও পারছিলাম না। কি লিখব ভাবতে ভাবতেই চা শ্রমিকদের আন্দোলনের বিভিন্ন ছবি দেখছিলাম। তখন আমার সেখানে আরেকটি প্লে কার্ড নজরে পড়ে যেখানে লিখা ছিল “দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরী চাই”। “আমি এবার আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম। ৩০০ টাকা মজুরীতে তাদের মাসিক ইনকাম হবে ৯৩০০ টাকা। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় ৩-৪ জনের ফ্যামিলির ইনকাম ৯৩০০ টাকা তেমন কিছুই নয়। বর্তমান বিশ্ব বাজার ও দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় যেকোনো শ্রমের জন্য ন্যূনতম মজুরী ৫০০ টাকা হওয়া উচিৎ। অথচ মাত্র ৩০০ টাকার জন্যই আন্দোলন করে যাচ্ছেন দেশের অনেক অসংখ্য চা শ্রমিকরা। আমি ভাবলাম পুঁজিবাদ আর মালিকপক্ষের শোষণনীতি চা শ্রমিকদের মাথার মধ্যে এমন ভাবে গেঁথে গিয়েছে যে তারা তাদের ন্যূনতম মজুরি দৈনিক ৫০০ টাকার কথা বলতেও সাহস পাচ্ছে না। মাত্র ৩০০ টাকার জন্যই তাদের আন্দোলন করছে। আর তা দমন করতে পুঁজিপতিদের নানান কসরতও চলছে।
শ্রমিকদের আন্দোলন দমন করতে বন্দুক উঁচিয়ে আসছে পুলিশ আর তার সামনে ক্ষুধার্ত মানুষের বুক চেতিয়ে আসা সাহসের ছবি আমাকে সাহস যোগায়।“এই প্রতিবাদী মানুষগুলো দেখলে আমি ভীষণ খুশি হই-আশান্বিত হই, এদের চোখের ভাষায় আমি আমার নিজের কথা কই।”
আসুন চা খাই, আর চা খেতে খেতে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পক্ষে সরব আওয়াজ তুলি “৩০০ টাকা মুজুরী চাই”। আবার যখন চা খাবো তখন যেন তাদের মুজরী নুন্যতম ৩০০ টাকা হয়। আবার যখন চা বাগানে ঘুরতে যাবো, তখন যেন তাদের মুখে একটি সফল আন্দোলনের গল্প শুনতে পাই।
লেখক: সভাপতি, কবির কলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ইমেইল-mishrabon@gmail.com
১৮ আগস্ট ২০২২খ্রি.
টেংকেরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।