রোজার ইতিহাস মানব সৃষ্টির ইতিহাসের কাছাকাছি। (সূরা বাকারা, আয়াত- ৩৫) ইসলাম-পূর্ব জাহেলী যুগেও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে রোজা রাখা হতো। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে রমজান মাসের কদরের রজনীতে হেরা পর্বতের গুহায় হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিকট ওহীর মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরআন অবতীর্ণ হয়।[ (‘আমি একে নাজিল করেছি শবেকদরে।’ (সুরা কদর, আয়াত : ০১)]
অতঃপর দ্বিতীয় হিজরিতে (৫২৪ খ্রিস্টাব্দে) শাবান মাসের ১০ তারিখে (রমজানের) রোজা ফরজ করা হয়েছে। (দুররে মুখতার, ৩য় খন্ড, ৩৩০ পৃষ্ঠা, ইমাম নববী (রঃ) “আল- মাজমূ”(৬/২৫০) -গ্রন্থে)
মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে মুসলিম জাতির উপর রোজা ফরজ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো।’
সূরা আল-বাকারা’র ১৮৫ নম্বর আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক কোন মাসের জন্য রোজা ফরজ করেন তাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ؕ
রমজান মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শন সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসে (নিজ আবাসে) উপস্থিত থাকে সে যেন সিয়াম(রোজা) পালন করে। (সূরা আল-বাকারাঃ ১৮৫)
ফারসি ভাষায় সিয়ামের প্রতিশব্দ হিসেবে রোজা ব্যবহৃত হয়, আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ (যার অর্থ উপবাস) এবং ইন্দো-ইরানীয় ধাতুমূল রোচস (যার অর্থ দিন বা আলো,যেহেতু আমলটি দিনের শুরু থেকে শেষাংশ পর্যন্ত ) থেকে রোজা শব্দের উদ্ভব। এর আরবি হলো সওম। বহুবচনে সিয়াম, সিয়াম শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। যে ব্যক্তি চুপ থাকে তাকে সায়েম বলে। সুরা মারইয়াম এর ২৬ নম্বর আয়াতে ‘সওম’ এর অর্থ হলো কথা বলা থেকে বিরত থাকা। প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়; বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই হলো (প্রকৃত) সিয়াম। সুতরাং যদি তোমাকে কেউ গালাগালি করে অথবা তোমার প্রতি মুর্খতা দেখায়, তাহলে তুমি (তার প্রতিকার বা প্রতিশোধ না নিয়ে) তাকে বলো যে, আমি সায়েম, আমি রোজা রেখেছি, আমি রোজা রেখেছি। (মুস্তাদরেকে হাকেম, ইবনে হিব্বান, সহিহুল জামেইস সাগির)
শত শত বছর আগে থেকে সাওম বা সিয়াম নামক ইসলামী উপবাস বোঝানোর জন্য বাংলা ভাষাতেও সমধিকভাবে ব্যবহৃত একটি শব্দ হলো রোজা।
✔সওম বা সিয়াম হলো প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নরনারী সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাধ্যতা মূলক ভাবে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস এবং অশ্লীল, গর্হিত প্রভৃতি কাজকর্ম, কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা।(ফাতহুল বারি)।
➤বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে পৃথক ভুক্তিতে দুটি রোজা দেখা যায়। একটি ফারসি উৎসের বাংলা পারিভাষিক রোজা : রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ (নজরুল)।
আরেকটি সংস্কৃত ‘উপাধ্যায়’ থেকে উদ্ভূত খাঁটি বাংলা রোজা,এর অর্থ— কল্পিত সর্পবিষচিকিৎসক বা ওঝা। – (রোজা এল ভূত তাড়াতে।)
রোজা,রোজাদার এগুলো ফারসি উৎসের বাংলা পারিভাষিক শব্দ।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান নিয়মমতে,
বিদেশি বিশেষ করে আরবি ফারসি শব্দে অন্তস্থ -য- এর স্থলে বর্গীয় -জ বিধেয়। তাই রোজা,রমজান,নামাজ, আজান, হজরত প্রভৃতি শব্দে বর্গীয়-জ হবে।
➤রমজান
রমজান শব্দটি শুধু ইসলামিক ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়,বরং ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও আরব সমাজে প্রচলিত একটি মাসের নাম। যেমন হজের মৌসুমকে যুল-হাজ্জাহ (জিলহজ) বলা হতো। সে-সময় বিভিন্ন বড় বড় ঘটনাকে স্মারক করে বর্ষ গণনার প্রচলন ছিলো। অনেকে বিশ্বাস করেন, সমস্ত ধর্মগ্রন্থ রমজান মাসে হাজির হয়েছিল। প্রথম রমজানে হজরত ইব্রাহিম (আ.) সহিফা, ৬ রমজানে হজরত মূসা (আ.) তাওরাত, ১৩ রমজানে ঈসা (আ.)-এর ওপর ইঞ্জিল, ১৮ রমজানে হজরত দাউদ (আ. জাবুর এবং ২৭ তারিখে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ হয়।
◑ হিজরি চান্দ্রবর্ষের নবম মাসের আরবি নাম রামাদান। রামাদান (رمضان) শব্দটি আরবি (ধাতু) মূল رمض (‘রমিদা’ বা ‘রমাদা’ /’রামিয়া’ বা ‘আর-রামম’) থেকে এসেছে। এর অর্থ প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। যেহেতু তখন রমজান উষ্ণ মৌসুমে আবর্তিত হতো, অন্যকথায় প্রথম রামাদান মাস পালিত হয়েছিল গ্রীষ্মে, তাই এমন নামকরণ হয়। পরবর্তী সময়ে যখন মাসটি হিজরি বর্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন রোজায় মানব স্বভাবের দিকে বিবেচনা করে শূন্য উদর বা খালিপেটের অবস্থাকে ‘রমদ’ বা আগুন-গরমের সঙ্গে তুলনায় রোজার মাসকে এই নাম দেয়া হয়েছে। আরবি ধ্বনিতত্ত্ব অনুযায়ী (رمضان) এ শব্দটি অঞ্চলভেদে রমজান, রামাদান, রমাজান উচ্চারিত হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে রমজানের পবিত্রতা একে বরকতপূর্ণ মাসে রূপান্তরিত করে। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা উচ্চারণে এটি হয় রমজান। রমাদান বা রামাদান থেকেই রমজানের জন্ম। সম উচ্চারিত অক্ষরের কারণেই রমাদান শব্দটি হাজার বছর ধরে বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে যুক্ত হয়ে বাঙালি সমাজে রমজান উচ্চারিত হয়ে আসছে।
নামকরণের আরেকটি সাংকেতিক কারণ হচ্ছে,
“রমজানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোজাদারের পেটে আগুন জ্বলে; পাপতাপ পুড়ে ছাই হয়ে রোজাদার নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এ মাসের নাম রমজান।” (লিসানুল আরব)।
◑ শব্দ ও উচ্চারণে ভিন্নতার কারণ:
শব্দ ও উচ্চারণে ভিন্নতা ছাড়া রমজান শব্দটির অর্থগত দিক নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান,ইরান এবং তুরস্কের মত মুসলিম দেশে এটিকে “রামাজান” বা “রমজান” হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
✪ ভারতীয় উপমহাদেশে আগত ইসলামী স্রোত মূলত পারস্য ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল! ফার্সিতে যেহেতু শব্দটা রমজান – যেখানে /জ/ য়ের উচ্চারণটা /Z/ র মতো! রমজান বা রামাদান আরবিতে : رمضان রামাদ্বান্ (সূরা বাকারা: ১৮৫) উল্লেখ করা আছে ; ফার্সিতে যা : رمضان র্যাম্জ্ন ! বাংলায় /Z/ উচ্চারণটা নেই বলে বাঙালি মুসলিম রমজান উচ্চারণ করত।
✪ পবিত্র কোরআনে রামাদান-ই বলা আছে। উর্দুতে মূল শব্দটা রমজান। কিছুতেই রামাদান নয়। আরবিতে /জ/উচ্চারণটা নেই, তার জায়গায় /ধ/ আর /Z/ র মাঝামাঝি উচ্চারণ করা হত- আর সেটা অনুসরণ করে ইদানীং রামাদান বলা হয়। ইংরেজি Ramadan শব্দ থেকে বাংলায় ‘রামাদান’ শুদ্ধ নয়। কারণ আরবিতে /আ/ র কোনও বালাই নেই।
✪ আরেকটি মত হল- আরবিতে সোয়াদ এর /দ/- /দ/ উচ্চারণ নয় আবার /য/ এরও নয়, মাঝামাঝি একটি উচ্চারণ রয়েছে! /দ/ /য/ নরম করে উচ্চারণ করা হয়, যা বাংলায় মাঝামাঝি উচ্চারণ!
অনুরূপ রমযান এর আরবি /দ/ নরম করে /দ/ ও /য/ এর মাঝামাঝি উচ্চারণ হয়!
✪ উচ্চারণের দিক থেকে বাংলায় রমযান ও রমজান এক হলেও বানানে ভিন্নতা রয়েছে। রমজান, রমযান, রামাদান, রামাধান কোনটিই ভুল নয়! তবে রমজান /জ/ দিয়ে লেখার প্রচলন জাতীয় কবি কাজী নজরুলের “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” থেকে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে!
বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান নিয়মমতে,
বিদেশি বিশেষ করে আরবি ফারসি শব্দে অন্তস্থ -য- এর স্থলে বর্গীয় -জ বিধেয়। তাই রমজান বানানেও বর্গীয়-জ হবে।
রমজান রমাদান না রামাদান বড় কথা নয়। বিশেষ উচ্চারণে অধিক সওয়াব এমনটিও নয়। গোলাপকে
যে নামেই ডাকা হোক তা সুগন্ধি ছড়াবেই। রোজা রাখাটাই হচ্ছে আসল কথা। রমজান নামে সন্নিবিষ্ট আরবি পাঁচটি বর্ণমালা যথা : রা, মীম, দোয়াদ, আলিফ এবং নুন-এর অন্তর প্রবাহে নূরে ইলাহীর প্রকাশস্থল মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জ্যোতির্ময় আমলী জিন্দেগির প্রভাব, অবিরাম কিরণ বর্ষণ করে চলেছে।
সংকলক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।