একদা এই শহরে মে দিবস পালিত হতো বেশ জমজমাট মিছিল, সভা এসবের মধ্য দিয়ে। এখন তা নিষ্প্রভ হয়ে উঠেছে। শুনেছি কলকাতা শহরে মে দিবসের আয়োজন ছিল শ্রমিকশ্রেণির একটা বড় প্রেরণা। শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিটাও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র। বিভিন্ন রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয় এবং বিভিন্ন শহরে মে দিবস পালনের ছবি দেখে আমাদের দেশের সচেতন মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিকশ্রেণি আশায় বুক বাঁধত।
আজ মহান মে দিবস। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম আর অনুপ্রেরণার এক দিন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐতিহাসিক এই দিনটিকে বিশ্বব্যাপী মে দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই দিন তাদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
মহান মে দিবস শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের চরম আত্মত্যাগে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক অবিস্মরণীয় দিন। বৈশ্বিক সংকটেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তবে মালিকরাও শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন; এটাই প্রত্যাশা সকলের।
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকায় প্রথম পালত হয়েছিল মে দিবস। সেদিন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে পথে নেমেছিল শ্রমিকরা। জমায়েত করে অতিরিক্ত শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল তারা। শ্রমিকদের জমায়েত ভাঙতে এলোপাথাড়ি বোমা, গুলি ছোড়েন পুলিশ। নিহত হয়েছিলেন বহু শ্রমিক। সেই সমস্ত শ্রমিকদের আত্মত্যাগ স্মরণে রেখেই ১ মে দিনটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস হিসাবে পালিত হয়।
এই ঘটনার তিন বছর পর ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস গঠিত হয়। সেখানেই ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে বার্ষিক দিবস হিসাবে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদিও ভারতে এই দিনটি পালিত হচ্ছে ১৯২৩ সাল থেকে। ভারত সহ মোট ৮০ টি দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস । বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে মে দিবসের অসীম গুরুত্ব রয়েছে।
উনিশ শতাব্দীর আগে কারখানার শ্রমিকদের দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করানোর চল ছিল। কিন্তু সেই তুলনায় তাদের বেতন ছিল যত সামান্য। যা তাদের জীবন ধারণের জন্যে যথাযথ ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে এই অতিরিক্ত শ্রমের বিনিময়ে অল্প পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়া মালিক শ্রেণির এই ভাবধারা ভেঙে চূড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল মে দিবস। আমেরিকা থেকে ধীরে ধীরে চিন, রাশিয়া, বাংলাদেশ, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে মে দিবসের তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবি।
মে দিবসের পথ ধরেই শ্রমিকদের নানা অধিকার অর্জিত হয়েছে। সেই সঙ্গে নিজেদের ও তাদের শ্রমের মর্যাদা পেয়েছে গুরুত্ব। বিশ্বব্যাপী ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। উন্নত দেশে এখন শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কাজের পরিবেশও হয়েছে উন্নত। তবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা ঘোচেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও তা মানা হচ্ছে না।
অনেক বেসরকারি শিল্প-কারখানায় আইএলও নির্ধারিত শ্রমঘণ্টাও মানা হয় না। দেশে শ্রমিক শ্রেণি শুধু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আগুনে পুড়ে ও ভবন ধসে প্রায়ই মরতে হয় তাদের। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে তাদের জীবন ও শ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সবাইকে। সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো, শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা। শ্রমিক শ্রেণি সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এখনো।
বাংলাদেশ শ্রমজীবী মানুষের দেশ, বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় দেশ। মে দিবসের গুরুত্ব এখানে একটু ভিন্নতর। দেশের উদীয়মান গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ লেগেই আছে। সরকার যদিও দাবি করে যে, ২০১০ সালেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৪৫০টি ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিষ্ট্রেশন প্রদনা করা হয়েছে, বিভিন্ন ট্রেডে ৬০ হাজার বেকার নারী পুরুষকে প্রশিক্ষণ, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, শ্রমজীবীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে, কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ কি থেমেছে?
শ্রমিক অসন্তোষ গার্মেন্টস শিল্পকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সেই ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। প্রায় ১০ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি। নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গের দুর্দশাও ঘোচেনি।
সূত্র মতে, শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। দেশে দেশে যুগে যুগে নানাভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছে শ্রমজীবী মানুষ। দিনরাত পরিশ্রম করেও তারা ঠিকমতো মজুরি পায় না। তার ওপর বেতন বকেয়া থাকা, কথায় কথায় শ্রমিক ছাটাই, লক আউট এসব কারণেও শ্রমিকদের দুর্দশার সীমা থাকে না।
কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ঝুঁকিমুক্ত নয়। অথচ গার্মেন্টস শিল্পের ২৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাদের জন্য নারী শ্রমবান্ধব পরিবেশ নেই অধিকাংশ গার্মেন্টেস শিল্পে। নেই স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম, অগ্নিনির্বাপণের আধুনিক ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে এখনও বেশিরভাগ গার্মেন্টস শিল্পে।
শুধু গার্মেন্টস নয়। ৮০ থেকে ৯০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। তাদেরকে অমানবিক জীবন যাপন করতে হচ্ছে। নারীদের জন্য বাড়তি রয়েছে নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি। পাক্ষিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এগুলোর দ্রুত ও কল্যাণকর সমাধান প্রয়োজন।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতাকে ভাবতে হবে নতুন করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভ‚তপূর্ব অগ্রগতি, বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রায় সব শিল্পকারখানা প্রবেশ করেছে অটোমেশনের যুগে। শ্রমিকদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে রোবট, কম্পিউটার, মাল্টিটাস্কিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি।
দেশের চল্লিশ লক্ষাধিক পোশাক শিল্প শ্রমিক প্রায় নিরক্ষর। তারা প্রাথমিক লেখাপড়া ও গণিত জানে না। কোডিং তো বহুদূর। অটোমেশন হলে এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যাবে কোথায়? এর জরুরি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে শিল্পকারখানার মালিক, বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকদের। মে দিবসে বিষয়টা অন্তত আলোচনায় উঠে আসুক সর্বস্তরে।