পুব আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবী সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে। চারদিক পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত। এমনই পরিবেশে কৃষকের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ছাঁটে গৃহিণীরা। পাখির কিচিরমিচির ডাকের সঙ্গে ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ ভেসে বেড়ায় কৃষকের আঙিনায়।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। এক সময় ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি লুকিয়ে ছিল আমাদের গ্রামবাংলার প্রাচীন জনপদে। ভোরের আজানের পাশাপাশি স্তব্ধতা ভেঙে ঢেঁকির শব্দ ছড়িয়ে পড়ত গ্রামের চারদিকে। এখন সেই শব্দ নেই। চোখে পড়ে না বিয়ে শাদির উৎসবের ঢেঁকি ছাঁটা চালের ফিরনি-পায়েস। অথচ একদিন ঢেঁকি ছাড়া গ্রাম কল্পনা করাও কঠিনতর ছিল। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি। কিন্তু আজ তা আমাদের আবহমান গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনও মাঝে মধ্যে গ্রামীণ জনপদে কিছু উৎসব-পার্বণে ধান থেকে আতপ চাল তৈরি করতে পিঠা বানাতে, চালের গুঁড়ি তৈরি করতে গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরে পুরনো ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়। আত্মীয়স্বজন একসঙ্গে ঢেঁকিতে বারা ভেনে যে আনন্দ পেয়ে থাকে তা কলে ছাঁটায় পাওয়া কখনও সম্ভব নয়। এখন শিক্ষার প্রসার গ্রামেও কমবেশি হয়েছে। গ্রামের বউ-ঝিরা বলতে গেলে প্রচলন না থাকাই অবশ্য। ঢেঁকিতে বারা ভানা প্রায় ভুলেই গেছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধা বা বয়স্ক মহিলারা গর্ব করে বলত এই ঢেঁকি আমার দাদাশ্বশুরের আমলের। শীতকালের পাখিডাকা ভোরে নবান্নের আনন্দে মেতে উঠত অজপাড়াগাঁ। এ সময় ঢেঁকির শব্দ কৃষককে মাঠে যাওয়ার জন্য তাড়া দিত। গ্রাম বাংলার ঘোমটা পরা বধূরা বিভিন্ন কায়দা-কানুনে ঢেঁকির তালে তালে তাদের বাপ-দাদার আমলের গীত গেয়ে চলত। কিন্তু এখন সর্বত্রই অসংখ্য যান্ত্রিক ধান ভাঙার মেশিন ঢেঁকির সেই মধুময় ছন্দ কেড়ে নিয়েছে। গ্রামীণ জনপদেও সেই কর্ম চঞ্চলতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে এ যন্ত্র।
এ ঢেঁকি একটি শিল্প। এক সময় ঢেঁকি শিল্পের ব্যাপক কদর ছিল। ছিল ঢেঁকি থেকে উৎপাদিত চালের ব্যাপক প্রচলন। লাখ লাখ পরিবার সরাসরি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। তৎকালীন সময়ে ঢেঁকিতে চাল বারানীরা তাদের উৎপাদিত চাল বিক্রি করে আর্থিকভাবে যে টুকু লাভবান হতো তাতে করে তারা কেবল নিজেদের সংসার খরচই মেটাত না, সেই সঙ্গে কিছু টাকা-পয়সা অন্য খাতে বিনিয়োগ অথবা সঞ্চয়ও করতে পারত। যারা এ পেশায় জড়িত ছিল বর্তমানে তারা পেশাচ্যুত। এ পেশার সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মহিলার বেঁচে থাকার পথ এখন রুদ্ধ হয়ে গেছে। আধুনিক চাল কলের ব্যাপক প্রসারের কারণে ঢেঁকি শিল্পীদের অনেকেই অর্ধাহারে, অনাহারে দিনমজুরি, ইটভাটা, ভিক্ষাবৃত্তিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পেশা বেছে নিয়েছেন। তা ছাড়া কেউ কাঁথা সেলাই আবার কেউবা দর্জির কাজ করেন। লাখ লাখ বিধবা তালাকপ্রাপ্ত এবং গরিব মহিলার সসম্মানে এবং গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষা করে বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল ঢেঁকি। গ্রামীণ সাধারণ মহিলাদের কাছে এটি ছিল অতীব প্রয়োজনীয় একটি কর্মসহায়ক হাতিয়ার। অনেক ক্ষেত্রে গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকির সংখ্যা দ্বারাই বিচার হতো কে কত বড় গৃহস্থ।
বর্তমানে আবার সুপার শপগুলোয় প্যাকেটজাত ঢেঁকি ছাঁটা চাল আসতে শুরু করেছে। ক্রেতাদেরও আগ্রহ বাড়ছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের। ঢেঁকি তৈরির জন্য বাবলা কড়ই গাছ আগে থেকেই বাছাই করে রাখা হতো। আবার নিজের পছন্দের কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করত অনেকে। কেউ কেউ নকশাদার শৌখিন ঢেঁকি তৈরি করত। আর এ ঢেঁকি তৈরির জন্য খোঁজা হতো ভালো কারিগর বা মিস্ত্রি। সময় নিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে কারিগররা ঢেঁকি তৈরি করে দিত। আর সেই ঢেঁকি মনঃপুত হলে গৃহস্থরা বিভিন্নভাবে তাদের পুরস্কৃত করত।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে সেই আদিকালের ধান ভাঙানের এ কাঠের উপকরণটি। ধানভাঙা কলের করাল গ্রাসে তা আজ আমাদের সংস্কৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে। এক সময় ঢেঁকি নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা কত না কবিতাই রচনা করেছেন আর বাউলরা গেয়েছেন গান। আজ আর সেই দিন নেই। পঞ্চাশের দশকে এ দেশে শুরু হয় চাল কলের প্রচলন। তারপর দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরে তা বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেছে। এখন সামান্য কৃষকও ধান কলের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
পূর্বে হেমন্তে ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত হতো গৃহস্থ বাড়ির আঙ্গিনা। মহিলারা সংসারের হাজারো অভাব অনটনের ভেতরেও নিজেদের ক্লান্তি ঢাকার জন্য ঢেঁকির তালে তালে সমবেত হয়ে গান গেয়ে ধান ছাঁটাইয়ের কাজ করতেন। কয়েক দশক আগেও গ্রামে গেলেই প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি চোখে পড়ত। গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকি থাকত একাধিক। তখন গ্রামে মহিলাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত কে কত ভোরে উঠে ঢেঁকিতে পাড় দিতে পারে বা বেশি ধান ভানতে পারে। ঢেঁকির শব্দে কৃষকের ঘুম ভেঙে যেত। মহিলারা যখন ধান ভানে তখন তাদের হাতের চুড়ি কিংবা কাঁকনের ঝনঝন শব্দ হতো। শব্দ হতো পায়ের নূপুরের। সব মিলে এক সঙ্গীতমুখোর পরিবেশ সৃষ্টি হতো।
এখন গ্রামে গেলে কারও কারও বাড়িতেই ঢেঁকি দেখা যায়। বর্তমানে সেগুলো অধিকাংশই অব্যবহৃত অবস্থায় গরুর গোয়ালঘরে কিংবা পরিত্যক্ত কোনো ঘরে পড়ে আছে। ঢেঁকির আওয়াজের সঙ্গে মহিলাদের চুড়ি আর নূপুরের সমন্বয়ে এর শব্দ এখন আর নেই। বর্তমানে এই ঢেঁকির গল্প শোনা যাবে শুধু নানি-দাদিদের মুখে মুখে। এ ছাড়া এখন শোনা যায় যন্ত্রচালিত রাইস মিলের শব্দ। হয়তো বিভিন্ন জাদুঘরে গিয়ে দেখা যাবে এই ঢেঁকি। আধুনিক সভ্যতার বিকাশে সব কিছু বদলে যাচ্ছে। এক সময় সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আর এখন গতিময় সভ্যতায় যাত্রা পথে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষেই তা বিলুপ্ত হতে চলছে। আবহমান বাঙালির হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য ঢেঁকি শিল্প। ইতিহাসের সেই ঐতিহ্য শুধু স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে চিরদিন-চিরকাল।