পৃথিবীতে ঋতুচক্রের পুরো ব্যাপারটি বেশ মজাদার। স্রষ্টা ভরপুর বৈচিত্র্য দিয়ে ছয়টি ঋতু সাজিয়েছেন। এই ছয় ঋতুতে প্রকৃতির একেক স্বাদের মেজাজ দেখতে পাই আমরা। ছোটবেলার রচনার বই স্মৃতির খাতা থেকে মনে করিয়ে দেয় সেই লাইন, ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ! ঋতুচক্রের পালাবদল মেনে এখন চলছে শীতকাল।
বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। ছয় ঋতু ক্রমান্বয়ে ঘুরতে থাকে প্রকৃতির বুকে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় শীত আসে সবুজ ছায়াঘন সুনির্মল প্রকৃতিতে। হেমন্তের শেষদিকে ফসল ভরা সবুজ, হলুদ মাঠ যে সময়ে রিক্ত হয়ে ওঠে, সেই সময়ে ঘন কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকে শীত আসে এ দেশের মাঠেঘাটে, অলিতে-গলিতে। ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে বাড়তে থাকে শীতের প্রাবল্য।
দক্ষিণের বিপরীত থেকে আসা মৃদু পবন এসময় অতু্যগ্র ঠান্ডা নিয়ে আমাদের মধ্যে হাজির হয়। প্রকৃতি এসময় তার দেহবসন খুলে নিজেকে মেলে ধরে খসখসে বিরক্তির মুখে। প্রকৃতিতে সৃজন হয় নতুন এক অধ্যায়ের, নতুন এক সৌন্দর্যের। শীতের সকালের এ সৌন্দর্যে প্রাণিজগৎ বিমোহিত হয়। প্রতিটি শীতের সকাল আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয় কুজ্ঝটিকায় ঘেরা উপমাহীন সৌন্দর্য নিয়ে। পুবের সূর্য আগুনের শিখা পুরোপুরি ফুটে ওঠার আগেই পশুপাখির হৃদয়ে সূর্য আসার গোপন সংবাদ সবার অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শীতের প্রাবল্য থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য সূর্যকে অভ্যর্থনা জানাতে গায়ের প্রতিটি গোয়াল ঘরে, বন-বাদাড়ে পশু-পাখির কণ্ঠে ভেসে ওঠে সূর্য আসার আহ্বানগীতি।
প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এর মধ্যে শীত ঋতু আমাদের সামনে হাজির হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন আবেশে। উত্তরের হিমশীতল হাওয়া আর কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে শীত আসে কনকনে বুড়ির মতাে। মানুষের কাছে শীতের দিনের প্রধান আকর্ষণ শীতের সকাল। এ সময় প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে। কুয়াশার ঘন সাদা পর্দা ভেদ করে নবীন সূর্যের আলাে পৃথিবীতে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারে না। হিমেল হাওয়ায় প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে শুরু হয় কাপন।
হিমের মৌসুম এই শীত। ঝরাপাতা, শিশির আর কুয়াশার মৌসুম। পিঠাপুলি আর রবিশস্যের মৌসুম। তার বেশ ঠান্ডা মেজাজ, কিন্তু কড়া ভীষণ! তো শীতের কড়া মেজাজের সাথে আমাদের জীবনযাত্রারও খানিকটা মেজাজ বদল ঘটে। রোজকার দিনলিপি পাল্টে যায় অনেকটুকুই। আর এই পরিবর্তনটা শহরে এবং গ্রামে দুই জায়গাতেই হয়। দুই অঞ্চলের জীবনযাত্রাই শীতকালের গল্প বয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে শীতকালটা উৎসবের সময় বলেই গণ্য হয়। তা সত্যিকারের অনুষ্ঠান আয়োজন দেখে তো বটেই, সাধারণ জনজীবন দেখেও আঁচ পাওয়া যায়।
পৌষ ও মাঘ এ দুমাস কুয়াশার নাচন শুরু হয় প্রকৃতিকে নিয়ে। উত্তরের হিমেল হাওয়া বয়, গাছপালা পাতাহীন হয়ে পড়ে। নদ-নদীতে স্রোতের তীব্রতা হ্রাস পায়। শীতের সকালে যখন ঘন কুয়াশায় সবকিছু ঢেকে যায় তখন প্রকৃতিকে অপূর্ব সুন্দর মনে হয়। পাণ্ডুর প্রকৃতির মধ্যে এক নীরব সৌন্দর্য দেখা যায় শীতের সকালে। এ সৌন্দর্য অনেকটা বিমূর্ত। শীতের সকালে প্রকৃতি আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন হয়ে পড়ে। কুয়াশার অবগুণ্ঠন ছিড়ে নিস্তব্ধতার বুক চিরে কোনাে পথিক হেঁটে গেলে মনে হয় শীতের কনকনে ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপছে। টিনের চালে, গাছের ডালে, ঘাসের ডগায়, শিশির বিন্দু জমে থাকার মনােরম দৃশ্য শীতের সকাল ছাড়া আর দেখা যায় না। ঘন সাদা চাদর মুড়ে থাকা প্রকৃতির বুকে মুক্তার মতাে ফুটে থাকা শিশির বিন্দুগুলাে চিকচিক করে। প্রকতি হয়ে ওঠে সতেজ। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয় হলুদ সরষে খেত আর ফুলের বাগান। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য যখন উঁকি দেয় তখন স্নিগ্ধ আলােয় ঝলমল করে কুয়াশায় ভেজা প্রকৃতি।
হ্যাঁ, এই কথা ষোলোআনা সত্যি যে, আর কোনো মৌসুমে মানুষজনের নিত্যদিনের জীবন এতটা বদলায় না, যত বদলায় এই এক শীতকালে। ওই যে বলেছি, শীতের কড়া মেজাজ! তার সাথে তাল মেলাতে মানুষজনকেও খানিক অভ্যাসবদল করতে হয় বৈকি। এই যেমন ধরুন, ভোরবেলা আপনি ঘুম কাটিয়ে উঠলেন, খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ ঝাপসা করে দিলো কুয়াশার চাদর। ভাগ্যক্রমে আপনার বাসার সামনে কিছু সবুজ ঘাসও চাদর পেতে রেখেছে। খালি পায়ে কয়েক কদম হেঁটে আসার কথা ভাবতেই পারেন সেই চাদরে। এমন উপলক্ষ এনে দেওয়ার জন্যে হলেও মানবেন, শীতকালটা একটু আলাদা বটে। তা আপনি যত বড় শীতবিরোধীই হন না কেন!
শহুরে জীবনে যেমন এই শিশিরভেজা ঘাসের চাদরে হাঁটার সুযোগ থাকলে আপনাকে ভাগ্যবান মনে করা হচ্ছে, গ্রামে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। সেখানে শিশিরবিলাসের সুযোগ মেলে সহজেই। আর বাংলাদেশের গ্রামে যে শীতের জীবন দেখেনি, সে সত্যিই দুর্ভাগা! শিশিরমাখা ভোর হোক, মিঠে রোদের বিকাল কিংবা ঘন কুয়াশার রাত, গ্রামের শীতকাল অপরূপা বটে।
ভোর পেরুলে যখন সূর্য আড়মোড়া ভাঙে, সকাল আসে অলস পায়ে, কোনোদিন তখনো কুয়াশার পর্দা সরে না পুরোটা। সেই কুয়াশার আড়াল ভেদ করে সূর্যের আলোকচ্ছটা দেখা যায়, প্রকৃতির সে এক বিশেষ রূপ। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ তার মাঝেই পথে নামে। এসব সকালে চা-দোকানের প্রয়োজনীয়তা খানিক বেশিই অনুভূত হয় বৈকি! হিম মাখানো সকালে জড়সড় হাতে গরম চায়ের কাপ, দিনের শুরুটা এভাবেই হয়।
প্রতিটি সকাল জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রাতের নীরবতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ব্যস্ত জীবনের নতুন দিন। বিশেষ করে সকালে পরিবেশটা অন্যরকম। শীতের সকাল বললেই আমাদের কল্পনায় ফুটে ওঠে প্রকৃতির অন্য এক চিত্র। শীতের সকালগুলো অন্য পাঁচটি ঋতুর সকালের চেয়ে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। শীতের সকালে মাঠ ঘাট সাদা কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায়। শিশিরে ভেজা মাঠের ঘাস, গাছের পাতা সব থরথর করে কেঁপে ওঠে উত্তরের হাওয়ায়। কুয়াশা ভেদ করে অবিরাম সূর্য যখন জ্বলে তখন প্রকৃতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কুয়াশায় কাছের জিনিসগুলোও দেখা যায় না, সবকিছু ঢেকে যায়। টিনের চালে, গাছের ডালে বা পাতায় শিশির পড়ে। পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় না। শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ে এবং ঝরে পড়ে। বাতাস যেমন শুকিয়ে যায়, তেমনি মানুষের মনও শুকিয়ে যায়। ডালিয়া ও চাঁদের মল্লিকা ফুলের উজ্জ্বল রং এই শীতের সকালের পরিবেশকে করে তোলে আরও রঙিন।
শহরে শীতের সকালটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকেই কাটে। শীতের সকালে শহরবাসীর ঘুম বিভিন্ন পাখির কলরবে না ভাঙলেও, ভাঙে কাকের ডাকে। শীতের সকালটা শহরবাসী ঘুমের মধ্যেই কাটিয়ে দেয়। শীতের সকালে তাদের লেপের উষ্ণতা। ছেড়ে কাজকর্মে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। যাদের সকালে উঠতেই হয় তারাও ছুটির দিনে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তাই শহরের লােকেরা গ্রামের মানুষদের মতাে শীতের সকালকে উপভােগ্য করে তুলতে পারে না। আর শহরে পিচ ঢালা রাস্তা কুয়াশায়। আচ্ছন্ন থাকে, শিশিরও পড়ে তবে গ্রামের মতাে শিশির ভেজা ঘাসের ছোঁয়ায় পথিকের মন আন্দোলিত হয় না। শীতের সকালে উঠে কনকনে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুতে ইচ্ছে করে না বড়ােদেরও, ছােটোরা তাে ঠান্ডা পানিতে ভয়ে পালাই পালাই করে। শহরের মানুষদের সূর্যোদয় দেখা, সূর্যাস্ত দেখা, শীতের সকালের কুয়াশা দেখার মন-মানসিকতা নেই। যান্ত্রিক জীবনে যারা অভ্যস্ত তাদের কাছে ওসব হলাে আবেগের ব্যাপার। তবে শহরের লােকেরা রংবেরঙের শীতের কাপড়ের মাধ্যমে শীতের সকালকে বরণ করে। কোট, জ্যাকেট, সােয়েটার, টুপি, চাদর, মাপলার প্রভৃতি আরামদায়ক পােশাক জড়িয়ে শীতের সকালে নিজ নিজ কর্মস্থলে বেরিয়ে পড়ে।
তবে গ্রামে-গঞ্জে শীতের সকালে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব দৃশ্য। শীতের সময় শাকসবজি, তরিতরকারি উৎপন্ন হয় বেশি। শীতের সকালে পাওয়া যায় টাটকা খেজুর রস। ভাপা পিঠার মৌ মৌ গন্ধে সকালবেলায় খিদে বেড়ে যায়। দুঃস্থ-দরিদ্র গ্রামবাসীদের শীতের সময় গরম জামাকাপড় থাকে না। রাতে তারা ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে। আর সুয্যি মামা উকি দেওয়ার আগে মনে হয় এই বুঝি সকাল হলাে, এই বুঝি সকাল হলাে। গ্রামের মসজিদে আজান হয়, ঘাের অন্ধকার ভেদ করে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা মসজিদে আসেন নামাজ পড়তে। ভরপেট পান্তা ভাত খেয়ে কৃষক কুয়াশাচ্ছন্ন ভাের বেলায় মাঠের কাজে যায়। গঞ্জের হাটে যায় কেনাকাটার জন্য। গ্রামের মক্তবে ছেলেমেয়েরা পড়তে যায়। মসজিদে বা মক্তবের কাছ দিয়ে হেঁটে গেলেই ছাত্র-ছাত্রীদের সজোরে সমবেত কণ্ঠে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার দৃশ্য চোখে পড়ে। কানে আসে তাদের কণ্ঠস্বর। শীত একটু বেশি লাগলে সকালবেলায় নাড়ার আগুনে ছেলের দল মটরশুটি পুড়িয়ে খায় আর আগুন পােহায়।
শীতের সকালে নদ-নদী গুলােতে তেমন পানি থাকে না। তখন নদী থেকে প্রচুর মাছ ধরা যায়। এজন্য শীতের খুব সকালে জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে চলে যায়। জেলে নৌকাগুলাে অল্প দূরে হলেও কুয়াশার ধূম্রজালে দেখা যায় না। আর সেই ধূম্রজাল ভেদ করে দূরযাত্রার নৌকা, লঞ্চ, ফেরি ইত্যাদি ভালােমতাে চলাচল করতে পারে না। তখন নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে হাড় কাঁপানাে শীত লাগে।
শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ হলাে বিভিন্ন রকম পিঠা। তখন গ্রামে প্রচুর খেজুরের রস পাওয়া যায়। খুব সকালে খেজুর গাছ থেকে হাঁড়ি নামানাে হয়। শীতের সকালে এ রস খেতে খুবই ভালাে লাগে। সকাল হতে না হতেই গ্রামগঞ্জে সর্বত্র খেজুর রসের পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে রােদ পােহাতে পােহাতে মুড়ি-মুড়কি, পিঠাপায়েস এসব খেতে পছন্দ করে। এ সময়ের প্রধান আকর্ষণ হলাে চিতই পিঠা ও ভাপা পিঠা। এছাড়া হরেক রকম পিঠা ঘরে ঘরে বানানাে হয়।
শীতের সকালে লেপ-কম্বলের ভিতরে আরামে শুয়ে থাকার মতাে সুখ আর কিছুতে পাওয়া যায় না। শীতের সকালে বিভিন্ন পিঠা দিয়ে নাস্তা করা, নানা রকম শীতের সবজি প্রভৃতি মানুষের মধ্যে সুখানুভূতি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, কনকনে শীতেও যাদের গায়ে দেওয়ার মতাে শীতবস্ত্র নেই, যারা রাস্তার পাশে শীতের হিমশীতল বাতাসে শুয়ে থাকে তাদের জন্য শীতের সকাল অনেক কষ্টের।
শীতের সকালে হাড় কাঁপুনে শীত পড়লে গ্রামের মানুষ জড়তা ও বিষন্নতায় ভােগে। মানুষের কাজের উদ্যম থেমে যায় । আরাম-আয়েস করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গরিব মানুষগুলাে গরম কাপড়ের অভাবে কষ্ট করে।
শীতের রাতে বা সকালে পরিবেশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। ফলে দূর থেকে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। মনে হয় কয়াশার সাদা পর্দা ছাড়া সামনে কিছু নেই। এ সময় রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলের ফলে দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। নদীপথে লঞ্চ-স্টিমার চলাচলের ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায় রাস্তায় বা নৌপথে চলাচল না করাই ভালাে।
শীতের সকালে শিশির ভেজা সােনালি রােদের স্পর্শ কার না ভালাে লাগে? সুবিধা-অসুবিধা দুয়ে মিলে শীতের সকাল আমাদের জীবনে প্রতি বছর দুই মাস সময় অন্যরকম ভালােলাগার অনুভূতিতে আমাদের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তােলে। শীতের সকাল অন্য সব ঋতুর চেয়ে একদম আলাদা। শীতের রিক্ততা প্রকৃতির সবুজকে ছিনিয়ে নিলেও দিয়ে যায় ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী বার্তা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা গোটা প্রকৃতি শীতকে যে একেবারেই উপভোগ করে না, তা ঠিক নয়। শীতের আবেদন চিরন্তন। হিমঠাণ্ডার কনকনে অনুভূতি প্রতিটি মানুষকে আলোড়িত করে। তাই শীত চলে গেলেও এর রেশ থেকে যায় এবং প্রকৃতি বসন্তের আগমন হেতু অপেক্ষমাণ হয়।
গ্রামাঞ্চল এখনো বহু জায়গায় পরম যত্নে আগলে রেখেছে শীতকালীন সংস্কৃতি, শীতের আদি জীবনধারা। সেসব জায়গায় সকালটাও শুরু হয় পিঠাপুলি তৈরি করে। চুলোর ধারে চাদর মুড়ে বসে আঁচ পোহাতে পোহাতে গরম পিঠায় কামড়, আহা! সে যেন স্বর্গের সুখ!
গাছ থেকে খেজুরের রসের হাড়ি নামানো হয় সকাল হলে, ছেলে-বুড়োর দল কাঁচা রস খাবে বলে আগ্রহে অপেক্ষা করে। সেই রস জ্বাল দিয়ে ঘন আর শক্ত করে তৈরি হবে গুড়, তা দিয়ে হবে পিঠা-পায়েস।
দুপুর গড়ালে গৃহী মানুষেরা ব্যস্ত হয় গোসল পর্ব নিয়ে। এক্ষেত্রে শীতকালের বদৌলতে তিন রকমের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। এক দলে আছে সেসব মানুষ যারা শীত বা গরম, কিংবা বর্ষা বারোমাসেই ঠান্ডা পানিতে গোসল সারে। আরেক দলের দেখা মেলে তাদের, যারা গরম পানি না হলে গা ভেজানোর সাহস করে না! অন্য দলে আছে সেসব বীর, যাদের কাছে শীত মানেই গোসল না করার কঠিন ব্রত! আর গোসলের পর যদি রোদের দেখা মেলে, তাতে গা ডুবিয়ে কিছুটা সময় ঝিমিয়ে নেয়াও ঢের আনন্দের। এই যে পানির সাথে আড়ি আর রোদের সাথে ভাবের সম্পর্ক, সব তো শীতকালেরই লীলা!
শীতের বিকাল বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী। এই আসে, একটু দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় আবার। শহুরে বিকেলগুলো আরো স্থবির। কুয়াশা যখন চাদর মেলে, চারপাশে কেমন একটা মন খারাপের ছবি আঁকা হয়। দিন মিলিয়ে যাবার বেলায় প্রকৃতি বিষণ্ণ হয় একটু।
গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে আর শহরের দিকে পথেঘাটে পিঠার পসরা বসে বিকাল হতে না হতেই। এদেশের শীতকালীন সংস্কৃতির একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে পিঠাপুলির নাম। ভাপা, এই পিঠার সময়ই শীতকাল। অন্য সময়েও তৈরি করা যায় বটে, কিন্তু ভাপা পিঠার সেই স্বাদ শীতকাল ছাড়া মিলবে না। আরো আছে চিতই পিঠা, সাথে হরেক পদের ভর্তা। শীতের সন্ধ্যায় এই খাবারের স্বাদ জিভে জল আনবে না, তা ভাবাও মুশকিল। পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি, তেলের পিঠা বা ঝাল পিঠা, পিঠাদের দল খুব ছোট নয়। আরেকটা মজার জিনিস আছে শহরে, অন্যান্য খাবারের আয়োজনে পুরুষ বিক্রেতাই বেশি দেখা গেলেও, পিঠার দোকানে প্রচুর নারী বিক্রেতা দেখা যায়। মানে মামাদের পাশাপাশি খালারাও থাকেন পেট আর মন ভরানোর দায়িত্ব নিয়ে!
কেমন করে যেন শীতকাল একটি খেলাকেও নিজের মৌসুমের বানিয়ে নিয়েছে! সেটি হচ্ছে ব্যাডমিন্টন। শীত আসতে না আসতেই পাড়ায় পাড়ায় ব্যাডমিন্টন কোর্ট তৈরির ধুম লেগে যায়। আগে যখন পাড়ায় কিছু খোলা জায়গা মিলতো, আস্ত মাঠও ছিলো কোথাও কোথাও, তখন বেশ আয়োজন করে কোর্ট বানানো হতো। চাঁদা উঠানো হতো সবার থেকে। নেট কেনা, বাঁশ পুঁতে নেট বাঁধা, সীমানা কাটা, শাটল কর্ক কিনে রাখা, খরচ তো কম নয়। আর রাতে খেলার জন্য বাতির ব্যবস্থা করা, ইলেকট্রিসিটির লাইন আনা, সে তো উৎসবের সমান! আজকাল মাঠেরা তো হারিয়েই গেছে পাড়া থেকে, খুব বেশি হলে রাস্তাটুকু জোটে খেলার জন্যে। কেউ কেউ বাড়ির ছাদে কোর্ট বানিয়ে নেয়। তবুও খেলা চলে। সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো ঠিকই বহমান থাকে খানিক হলেও।
সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডা জমে ওঠে আরো, সাথে পিঠার ভোজ। খেজুর গুড়ের চা-ও চলে কোথাও কোথাও। পিঠার দোকানিরা ভীড় সামলাতে হিমশিম খায়। ব্যাডমিন্টন ম্যাচের উত্তেজনা বাড়ে। রাতটা হয়তো কারো খেলা হবে না, তাই সন্ধ্যাতেই সাধ মিটিয়ে নেওয়া চাই! আরো এক ম্যাচ, আরেকটা বার, চলতেই থাকে। বুড়ো খোকারা বৈকালিক হণ্টনপর্ব শেষে বাড়ির পথ ধরার আগে পিঠার দোকানে একটু দাঁড়ায়, বাসায় থাকা বুড়িটার জন্য পিঠা নিয়ে গেলে তো মন্দ হয় না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে, রাত বাড়ে। শীতের রাত সুদীর্ঘ। সময় কাটতে না চাওয়ার রাত, হিমঝরা হাড় কাঁপানো রাত আসে কখনো। রাস্তার ধারে আগুন জ্বেলে তার ধারে হাত-পায়ে সেঁক নেয় লোকজন। ভারী পোশাকে শীতকে মানিয়ে নেওয়ার কী ভীষণ চেষ্টা থাকে রাতের রাস্তায়। আধহাত দূরের মানুষও দৃষ্টির আড়াল হয় কুয়াশার চাদরে।
এক বাড়িতে লোকজন জলদি ঘুমের প্রস্তুতি নেয়, তো অন্য বাড়িতে দীর্ঘ রাতের সুযোগে গল্প চলে আরো কিছুক্ষণ। লুডো কিংবা দাবার বোর্ডে সময় কাটানোর সময় হয় পরিবারের মানুষগুলোর। হ্যাঁ, এসব কারণেও শীতকাল বিশেষ বটে।
নিত্যদিনের প্রতিবেলার গল্প তো গেলো, তা আর কি আছে শীতের? আছে, আরো অনেক কিছুই আছে। সেসব কেমন? এই যে, বাঙালির শীতকাল মানেই বিয়ে যেমন! দাওয়াত খেয়ে খেয়ে উদরপূর্তি করে বেড়ানোর দারুণ সময় শীতকাল। গরমের দিনে ভুরিভোজে একটু অসুবিধা থাকলেও শীতের ঠান্ডা আমেজে ভোজনোৎসব চলতে থাকে আরামে। শীতেই কেন এত বিয়ের আয়োজন হয়, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও, ভুরিভোজনের বেলায় সকলেই প্রায় একমত, শীতের আবহাওয়া এই কাজের পক্ষে অধিক ভালো! পিঠাপুলি ছাড়াও শীতের বিশেষ সবজি, নতুন গুড়ের পায়েস, রসনাবিলাসের শেষ কি আর হয়! খাওয়া চলে ভরপুর, আর তা বিয়েবাড়ির খাওয়া হলে তো কথাই নেই।
আদিগন্ত হলদে ফুলের সরিষাক্ষেত কার না মনে আসবে বাংলাদেশের রূপ কল্পনা করলে? এই ছবিটাও সরাসরি দেখতে পাওয়া যায় শীতকালেই। হলুদ চাদরে ঢেকে যায় সরিষার ক্ষেত, তার মাঝে সবুজ পাতার আঁকিবুঁকি, মনোহরা এই দৃশ্য শীতের দিনেই আসে।
এই শীতে আরো আসে বাইরের দেশের অতিথিরা। ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশের সীমানায় ঢুকে যায় তারা, ডানাই যাদের ভরসা। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভরে যায় অসংখ্য অতিথি পাখির কোলাহলে! খাল-বিল, হাওড়ে এই অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ থাকে শীতজুড়ে। তারা আসে নিজেদের দেশের ভয়ানক ঠান্ডা থেকে বাঁচতে। আর এ দেশের জন্য সাথে নিয়ে আসে আনন্দের আরেক উপলক্ষ। হাজারো মানুষ ভীড় জমায় তাদের দেখতে, তারা যে অতিথি।
অনেক পরিবারের কাছে শীতকাল এক অপেক্ষার নাম, দূরে বেড়াতে যাওয়া যে এই সময়ের জন্যই তোলা! দিনব্যাপী পিকনিক, সেটারও ধুম পড়ে এই শীতেই। নগরের বুকে পিঠা উৎসবে চেনা-অচেনা পিঠার পসরা রসনা তৃপ্ত করে। শীতকালীন সবজিগুলো নিরামিষ বিমুখ মানুষটাকেও হাতছানি দেয় খাবার টেবিলে। শীতকালের বিশেষ হবার কারণ গুনে শেষ হবে না।
এসব গল্প নিয়েই একেকটা শীত পার হয় এই দেশে। ঋতুভিত্তিক এত বৈচিত্র্য, এত রূপের বাহার, শীতকালে তার সবকিছুই ভিন্ন মাত্রা পায়। শীতের বাংলাদেশ আরো রূপসী হয় তাতে, হয় আরো অনেক বিশেষ।
ঋতুচক্রের পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি আবার অন্য রূপে সাজে শীতের শেষভাগে। আর তাই তো প্রকৃতিকে অপরূপ রঙে সাজিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বিদায় নেবে শীত।
ষড়্ঋতুর এই দেশে একেকটি ঋতু একেক রূপ-রং নিয়ে হাজির হয়। অভ্যস্ত মানুষ প্রকৃতির এই পালাবদলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন খুব সহজেই। শীত একদিকে যেমন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে, অন্যদিকে তীব্র শীত জীবনযাত্রা বিপন্ন করে তোলে মানুষের। বিশেষ করে দরিদ্ররা শীতের কাপড়ের অভাবে কষ্ট পায়। এই সময়ে শীতজনিত নানা রোগব্যাধিও দেখা দেয়। তাই শীতের জন্য আলাদা প্রস্তুতি রাখা উচিৎ। শীত মৌসুমে বৃদ্ধ ও শিশুদের ঠান্ডাজনিত নানা রকম রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যে জেঁকে বসেছে শীত। কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক। কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা কমে আসে। দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলও বিঘ্নিত হয়। এজন্য সতর্কবার্তা অবলম্বন করা উচিৎ। এ সময় শৈত্যপ্রবাহেরও আশঙ্কা থাকে।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ঋতুর পরিবর্তন হবে, এটাই স্বাভাবিক। এজন্য শীত যেন উপভোগ করা যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। তীব্র শীতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে কষ্ট না পায়, সেজন্য গরম কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শীতের সময় দেখা যায় অনেকেই শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। কিন্তু সেটা যেন কেবলই ‘ফটোসেশনের’ জন্য না হয়। প্রকৃত অর্থেই শীতার্তরা যেন উপকৃত হয়। সমাজের বিত্তবানদের এজন্য এগিয়ে আসতে হবে। শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে সামর্থ্য অনুযায়ী। কবি সুকান্ত যেমন করে সূর্যের কাছে উত্তাপ চেয়েছিলেন ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটির জন্য’, তেমনিভাবে আমাদের মধ্যে এই শীতে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। আর তখনই শীত কষ্টের ঋতু না হয়ে উৎসবের ঋতু হয়ে উঠবে।