মোঃ রুহুল আমিন, চাঁদপুর থেকে: চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার চাঞ্চল্যকর শিশু খাদিজা অপহরণ মামলার কোনো রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ তিন মাসেও সন্ধান মিলেনি অপহৃত হওয়া সাড়ে পাঁচ বছরের শিশু খাজিদার আক্তার মায়া’র ।খাদিজার কোনো খোঁজ না পেয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তার বাবা-মা ও স্বজনদের।শিশু খাদিজা মায়ের কোলে ফিরে আসবে সেই আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন খাদিজার মা-বাবা।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার রহস্য জানতে দীর্ঘ অনুসন্ধানকালে জানা যায়, চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের ছোট তুলা গ্রামের সাব্বির হোসেন আব্দুল্লাহ-ফাতেমা আক্তার দম্পতির সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী শিশু খাদিজা আক্তার মায়া। বিগত ১১ এপ্রিল পাশ্ববর্তী বাড়ির উঠানে খেলাধুলা করার সময় হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। ঘটনার দিনই নিখোঁজ শিশুর মা ফাতেমা আক্তার(ফাতু) শাহরাস্তি থানায় লিখিত এজাহার দায়ের করেন।যার নং-৪৭৪ তারিখ ১১/৪/২০২১ইং।
শিশু খাদিজাকে তাঁর আত্মীয়-স্বজন সহ বিভিন্ন পরিচিত জনদের বাড়িতে ও জায়গায় খুঁজে না পেয়ে ঘটনার ২৭ দিন পর পূর্বে দায়ের করা এজাহারে অভিযুক্ত একই গ্রামের পাশের বাড়ির বাসিন্দা প্রবাসী হাফেজ শেখ ফরিদ আহম্মেদের দুই ছেলে মোঃ রবিউল আউয়াল (২৫) ও মোঃ ফরহাদ (৩০) সহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে ধারা ৭/৩০ -২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনী ২০০৩, অপহরণ ও অপহরণের সহায়তা করার অভিযোগে শাহরাস্তি মডেল থানায় মামলা দায়ের করা করে।যার নং – ৭, তারিখ ০৭/৫/২০২১ইং।
মামলা হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। এই মামলার দুই সহোদর আসামি রবিউল আউয়াল ও ফরহাদকে গ্রেফতার করে শাহরাস্তি মডেল থানার পুলিশ।গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দুই সহোদরকে।রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ ছোটতুলা গ্রামের খাদিজাদের বাড়ির পাশের ঘরের নিকট আত্মীয় আবুল খায়ের পাটোয়ারির দ্বিতীয় ছেলে সরোয়ার হোসেন(৫৫), ছোটতুলা গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে হালিমা আক্তার(২৪), পাশ্ববর্তি বড়তুলা ভূঁইয়া বাড়ির বাসিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবু তাহের মাস্টারের দ্বিতীয় ছেলে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী একরাম ভূঁইয়া সহ একই ইউনিয়নের চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের চিতোষী গ্রামের মৃত. সুবাস চন্দ্র দাসের ছোট ছেলে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী হিমাংসু চন্দ দাস(২৫) নামে আরও চার জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। তবে এই ঘটনার সাথে যুক্ত একই গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে শামছুল আলম সুমন কবিরাজ নামে আরেকজন এ ঘটনার পর পরই গা ঢাকা দিয়েছে।সুমন কবিরাজ শিশু খাদিজাকে লুকিয়ে রেখেছে বলে বিভিন্ন মহল ও এলাকাবাসি থেকে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এখনো অধরাই রয়ে গেছে এলাকায় ধূর্ত হিসেবে পরিচিত কথিত সেই সুমন কবিরাজ।মামলার বাদী অপহৃত খাদিজার মা ফাতেমা বেগম(ফাতু)’র দাবি, এই শামছুল আলম সুমন কবিরাজকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই তার সন্তানের খোঁজ মিলবে এবং প্রকৃত তথ্য জানাযাবে।
অভিযোগ রয়েছে,বিগত ১০ বছরে এই বড়তুলা এবং ছোট তুলা গ্রামে প্রায় ২০টি শিশুকে দত্তক গ্রহন করেছে এলাকার বিভিন্ন পরিবার। এসব শিশু কোথায় থেকে কিভাবে এই গ্রামে এসেছে তার কোনো হদিস আজো পাওয়া যায়নি। ইতিপূর্বেও এই সুমন কবিরাজ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। সুমন কবিরাজ শিশু খাদিজা অপহরণের পর তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেও বিভিন্ন মুখরোচক গল্প ও নাটক সাজায় বলে জানিয়েছে এলাকার লোকজন। এই কবিরাজ শিশু পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত থাকতে পারে বলেও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সন্দেহ রয়েছে। অন্যকে ফাঁসাতে খাদিজাকে লুকিয়ে রাখার জন্য সুমন কবিরাজকে কেউ ব্যবহার করতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন অনেকেই। অপরদিকে এ ঘটনায় খাদিজাদের নিজ বাড়িতে বিল্ডিং এর কাজ করা খাদিজার দাদার পুরাতন বাড়ি রামগঞ্জের লোকজনকেও সন্দেহ করছেন এলাকার মানুষজন।
এ ঘটনায় গত ১২ জুন চাঁদপুর প্রেসক্লাবে খাদিজার মা ফাতেমা আক্তার(ফাতু) সংবাদ সম্মেলন করেন। অপহৃত শিশু খাদিজার মা বলেন, খাদিজা অপহৃত হওয়ার কিছুদিন পূর্বে তার কাছে ৫০ হাজার টাকা ধার চেয়েছিল মামলায় অভিযুক্ত দুই ভাই রবিউল ও ফরহাদ। সেই টাকা না পেয়ে প্রতিবেশী রবিউল আলম ও তার ভাই ফরহাদ ক্ষুব্ধ হয়ে অপহরণ করেছে তার শিশু কন্যা খাদিজাকে।
এদিকে রবিউল-ফরহাদের মা ফাতেমা বেগম শিশু খাদিজার মা ফাতেমা বেগম(ফাতু’র)’র অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করে বলেন, আমার ছেলে রবিউল একটা বিদেশী কোম্পানিতে চাকুরী করে।সে টাকা ধার চাইবে কেনো? আর ফরহাদ কৃষি কাজ করে। আমার ছেলেদেরকে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা অভিযোগ তুলে মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমার ছেলে রবিউল-ফরহাদ ফাতেমার জিঘাংসার শিকার। তিনি বলেন, আমার ছেলেরা এমন কাজ কখনো করতে পারে না।এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখুন আমার ছেলেদের কথা মানুষজন বলবে। ওরা নির্দোষ। ওরা শিশু খাদিজার মায়ের প্রতিহিংসার বলি হয়েছে। আমি আমার ছেলেদের মুক্তি দাবি করি।
অপরদিকে এলাকার লোকজন বলছেন, অপহৃত শিশু খাদিজার দাদা-দাদি পাশের উপজেলা রামগঞ্জ থেকে ছোটতুলা গ্রামে ৩০ বছরেরও বেশি সময় আগে জায়গা খরিদ করে বসবাস শুরু করেন।সেই সুবাধে এই গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সাথে তাদের সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্ক তেমন একটা ভালো নয়।এমন কি পাশ্ববর্তী বাড়ির জনপ্রিয় চেয়ারম্যানের সাথেও তাদের তেমন কোন সম্পর্ক নাই। বিভিন্ন কারণে অনেকেই খাদিজার পরিবারকে সামাজিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না।খাদিজার মায়ের বাড়ি পঞ্চগড়ের তুলারডাঙা এলাকায়।খাদিজার দ্বিতীয় নানি থাকেন ছোটতুলা গ্রামে। নানীর বিশাল সম্পত্তি রয়েছে একই গ্রামে।ঐ পৈত্রিক সম্পত্তির অংশীদার অপহৃত খাদিজার মা ফাতেমা বেগম(ফাতু)নিজেও।দ্বিতীয় নানীর কোনো ছেলেসন্তান না হওয়ায় ফারুক হোসেন(৫০) নামে এক ছেলেকে দত্তক আনেন খাদিজার নানী। তাদের সম্পত্তি সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করেও খাদিজাকে অপহরণ করা হতে পারে বলে এলাকায় গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।এছাড়াও এলাকার বিভিন্ন মানুষকে শায়েস্তা করার জন্যও কেউ খাদিজাকে লুকিয়ে রেখে অপহরণ নাটক মন্থস্থ করতে পারেন বলে গুঞ্জন ও আলোচনা রয়েছে।
এই মামলায় একরাম হোসেন ভুঁইয়া নামে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী (ইতিপূর্বেও একরাম ভুঁইয়া দুইবার চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দীতা করেছেন)বড়তুলা গ্রামের প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অন্য গ্রুপের আরেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এলাকায় একরাম ভুঁইয়া বেশ জনপ্রিয় একজন মানুষ। একরাম স্বেচ্ছায় সব সময় এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। তার জনপ্রিয়তায় এলাকায় একটি পক্ষ তাকে শায়েস্তা করতে শিশু খাদিজার অপহরণ মামলায় তাকে জড়ানো হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
এলাকার সচেতন লোকজন বলাবলি করছেন শিশু খাদিজাকে তাঁর পরিবারই লুকিয়ে রেখে এমন নাটক সাজাতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে একরামের বিষয়ে খাদিজার মা ফাতেমাকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও একরাম নিরঅপরাধ বলে উল্লেখ করে।
একদিকে এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার অন্যদিকে এলাকার কিছু মানুষকে শায়েস্তা করাই খাদিজার পরিবারের উদ্দেশ্য হতে পারে।একরামকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এলাকার লোকজন।
এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষজন বলছেন আমরাও চাই ছোট্ট শিশু খাদিজা মা-বাবা’র কোলে ফিরে আসুক। এলাকায় শান্তি ফিরে আসুক। এদিকে স্বামী পরিত্যাক্তা হালিমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে তার বাবা বৃদ্ধ মোঃ রফিক উল্লাহ পাটওয়ারী দাবি করেন। বৃদ্ধ বাবা মোঃ রফিক উল্লাহ পাটওয়ারী বলেন, আমার উনুনে আজ আগুন জ্বলে না। হালিমার শিশু বাচ্ছাটির কান্না থামানো যাচ্ছে না। এদিকে হিমাংসু, সরোয়ার নামে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পরিবারের অভিযোগ এরা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার।
এ বিষয়ে শাহারাস্তি থানার ওসি মোঃ আবদুল মান্নানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, শিশুটি নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে থানায় একটি জিডি করা হয়। পরবর্তীতে ঐ জিডির সূত্র ধরেই অপহরণ মামলা হয়। এই মামলায় ২ আপন ভাই ফরহাদ ও রবিউল সহ অজ্ঞাতনামাদের আসামী করা হয়েছে। পরে আমরা এজহারভুক্ত আসামী ২ জন এবং ১ জন মহিলাসহ আরো ৪ জনকে গ্রেফতার করি। মহিলা ছাড়া অন্য ৫ জনকে রিমান্ডেও আনা হয়। বর্তমানে তারা জেল হাজতে রয়েছে।মামলাটি এখন পিবিআই’তে আছে।
শিশু খাদিজা অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (পিবিআই) সাব-ইন্সপেক্টর মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের এসপি মহোদয়ের নির্দেশে আমরা এই আলোচিত মামলার রহস্য উদঘাটনে কাজ করে যাচ্ছি।মামলার তদন্তের স্বার্থে এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে খুবই সুক্ষভাবে আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।খাদিজাকে খুঁজে পেতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।