
জন্ম দিলেই সবাই পিতা হতে পারেনা, আবার জন্ম না দিয়েও পিতার কতব্য পালন করে পিতার আসন লাভ করা যায়। আমার জীবনে নানা বাড়ি,নানা, মামা,মামির অবদান অনেক বেশি। আমার মা’কে ছোট্ট বেলা মানে আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখেছি আমার মামার বাড়িতে থাকে,ভাইয়ের সংসারে। আমিও একটু একটু করে মামার সংসারে অন্য মামাতো ভাই বোনদের সাথে বেড়ে উঠেছি,মামা মামির আদরে যত্নে। আমার দুই মামা। বড় মামা লোকমান হোসেন আর ছোট মামা জালাল উদ্দীন সরদার। আমরা মূলত জালাল উদ্দীন সরদারের স্নেহ ভালোবাসার ছায়ায় থেকেছি। সময়ে সময়ে শাসনও করেছে,বাবার যেমন সন্তানকে করে।
আমার নানা আব্দুল বারেক, ছোট্ট বেলা নানার সঙ্গে চুকিতে ঘুমিয়েছি,নানার কাছ থেকে শুনেছি কেচ্ছা, গল্প। আগাগোড়া একজন ধার্মিক মানুষ আমার নানা কে কোন দিন দেখনি এক ওয়াক্ত নামাজ কাইজা করতে। নানার নামাজ শুরু হত তাহাজ্জুদ নামাজের মধ্য দিয়ে ফজর নামাজের আরো অনেক আগ থেকে। শেষ হত সারে সাতটার পর এশরাক নামাজের পড়ে।(এশরাক সূর্যোদয়ের পর হতে সূর্য মধ্য আকাশে আসার পূর্ব পর্যন্ত সময়কে ‘দোহা’ বলা হয়। এ সময়ের মধ্যে ২ থেকে ১২ রাকাআত নামাজের কথা হাদিসে এসেছে। সূর্য উদয়ের পর যে ২ বা ৪ রাকাআত নফল নামাজ পড়া হয় তাকে ইশরাকের নামাজ বলে)এই নামাজের মাধ্যমে এক হজ ও উমরার সওয়াব পাওয়া যায়।
আমার নানা প্রাই আশি বছরের অধিক সময় বেঁচে ছিলেন,সাদা মনের মানুষ বলতে যা বুঝায় তার চিরন্তন হবে আমার নানার জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠা। আমার মনে আছে, আমি মামা মামির সংসার বড় হচ্ছি,ঠিক ভাবে আমার যত্ন হচ্ছে কি না এ নিয়ে নানা পেরেশানিতে থাকত। আমাকে নিয়ে নানা যে এ ভাবনা ছিল একটা ঘটনা।
উল্লেখ করলেই বুঝতে পারবেন। আমি ছোট, নানা পাশের বাড়ির একজনের সঙ্গে দুধ রোজ করলেন,প্রতিদিন একপোয়া দুধ। আর সে দুধ আমি সে বাড়িতে গিয়ে বিনা জ্বালে, কাঁচা গিয়ে খেয়ে আসতাম। ছোট্ট বেলা থেকেই কাঁচা দুধ,কাঁচা ডিম খেয়ে আমি অব্যস্থ হয়ে যাই নানার কল্যাণে। আমি ছোট্ট বেলা থেকেই ঔষধ খেতে কিংবা ইনজেকশন নিতে দারুণ ভয় পেতাম। তখন এখনকার দিনের মত ঔষধ ডাক্তার এত সহজলভ্য বিষয় ছিল না। ডাক্তার বলতে মেড্ডার পলিন ডাক্তার, পরিন্ধা ছিল যার প্রধান ঔষধ। আর ছিল মিষ্টি একধরনের সাদা সাদা ছোটছোট বল।যেগুলো একসঙ্গে একবারে মুখে দিয়ে খাওয়া যেত।আমি অসুস্থ হলে ঔষধ খাওয়ানো আমার মায়ের জন্য বড় কষ্টকর বিষয় হয়ে উঠত।একদিন মা কায়দা করে একটা কলার মধ্যে একটা টেবলেট ঢুকিয়ে এনে কলাটা আমাকে খেতে দিল।আমিও শিশুমনে মায়ের দেওয়া কলায় কামড় দিয়ে চিবুনি দিতে টেবলেটের তিতায় তিক্ত হয়ে উঠল সারা মুখ। আমার চিৎকার চেচামেচি সেদিন দেখে কে! মনে আছে আমার নানার একটা ওযুর বদনা ছিল,ওযুর বদনায় থাকা সবটুকু পানি খেয়েও আমার মুখের তিতা দূর হচ্ছিলনা,কি এক আজব শিশু ছিলাম আমি!ওযুর বদনার পানি খাওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা আছে আমার। আমি সহ আমরা তিন ভাইয়ের মুসলমানি করা হয়েছিল একইদিনে। আমার আর দুই মামাতো ভাই একজন বড় মামার ছেলে খায়ের ভাই,আর ছোট মামার বড় ছেলে আল আমিন ভাই। আমি তিনজনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।
মনে আছে তখন তিব্র গরমের দিন। মামি প্রতিদিন কুসুম গরম পানি খেতে দেয়।খাবার হিসাবে দেয় পোলাও মাংস। প্রতিদিন বিকেল বেলা বুড়োই ডাল ছোট ছোট করে লাকরি করে ঘরের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে সে বুড়োই ডালের সেক দেওয়া হত আমাদের বিশেষ অঙ্গে। বিশেষ অঙ্গের কর্তন জনিত কারণে আমাদের ঠান্ডাপানি পান করা ছিলো নিষিদ্ধ। কিন্তু গরমে অতিষ্ঠ আমি পিপাসিত হয়ে সবার অগোচরে নানার বিশেষ ওযুর বদনার সকল পানি পান করে ফেলি।যার ফলস্বরূপ বা বলা চলে কুফলস্বরূপ আমার বিশেষ অঙ্গে পানি পটিলির জন্ম হয়। অন্য দুজন থেকে সে পর্বে আমার ঘাঁ শুকাতে অনেক সময় ব্যয় হয়।
ছোট বেলা আমার দিনগুলো কেটেছে পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলে দোলে। মা মামীর টুকটাক ঝগড়া ঝাটি ছাড়া তেমন কোন জটিলতা ছিলনা সে সময়। গ্রামের আর আট দশজন পুরুষ যখন সারাদিনে পঞ্চাশ টাকা রোজগার করে সে সময়ই মামা প্রতিদিন পাঁচশো টাকার উপর আয় করতেন। বাজারের প্রথম ফল,বড় মাছ,বা যে কোন সৌখিন জিনিস মামা আগে বাড়িতে আনতেন। সারা মহল্লার মধ্যে ভিট পাকা ইটের দেয়াল দেওয়া ঘর নির্মাণ করে মামাই। প্রথম দিকে নানার বিধিনিষেধের কারণে টেলিভিশন আনতে পারিনি মামা। কিন্তু মহল্লার প্রথম সাদা কালো টেলিভিশনটা মামাই আনে প্রথম। সে কি উদ্দীপনা এ টেলিভিশন নিয়ে সারা মহল্লার ছেলে পেলেদের মধ্যে! মামা নিজের রোজগার দিয়ে একেরপর এক জমি কিনতে লাগল,যে একসময় নানা অল্প দামে বা নাম মাত্র দামে বিক্রি করে দিয়েছিল সব আবার মামা ফেরত আনতে লাগল। আদর ভালোবাসা আর শাসনের মধ্যে দিয়ে এক ঝাঁক শিশু একসাথে বেড়ে উঠেছি এক বাড়িতে।একবার ছোট বেলা আমার আমাশা রোগ হয়।
অনেকদিন কষ্ট করছি রোগটা নিয়ে, আর আমি ঔষধ ও খাই না,মামাকে কে যেন বলেছে মিষ্টির দোকান থেকে গরম মিষ্টি আর মিষ্টি রস এনে খাওয়ালে আমাশা রোগ সেরে যাবে।মামা একদিন আধা কেজি মিষ্টি রস সহ এনে আমাকে খেতে দেয়।আমি সে মিষ্টি ও রস খেয়ে সত্যিই আরগ্য লাভ করি।
একজন বাবার মতোই আমাকে মানুষ করেছে মামা।হঠাৎ করেই আজ ২০.০৫.২৫ তারিখ রাত এগারোটা ৪৫ মিনিটে খবর খবর এল আমার সে মামা আর পৃথিবীতে নেই। খবরটা শোনার পর সকল পর্যন্ত দু-চোখের পাতা আর এক করতে পারনি আমি।আজ আমি একজন সত্যিকারের অভিভাবক হারালাম। বেদনা বিধুর রাত শেষ হবার অপেক্ষায় প্রহর গুনে চলছি প্রিয় মুখটি শেষ বারের মত দেখার অপেক্ষায়।