ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে কয়েকজন গুণী মানুষের সাথে আমার মেশার সুযোগ হয়েছে বা যাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে, তাদের কয়েক জনকে কাছ থেকে দেখে এই ভেবে আমি অবাক হয়েছি যে তাঁদের এতো গুণ, যোগ্যতা, পরিচিতি থাকার পরও তাঁরা কেনো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পড়ে থাকেন। অথচ তাঁরা যদি শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে ব্যস্ত না থেকে জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে, দেশময় খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন। পারতেন অর্থ বা ক্ষমতার মালিক হতে। কিন্তু তাঁরা তা না করে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়েই কেন ব্যস্ত থাকেন। নিজের কাছে করা আমার সে প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে “ভালোবাসা যেখানে মুখ্য; অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি বা ক্ষমতা সেখানে গৌণ”।
তার তাইতো কিছু মানুষের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতি আপন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ, রাস্তা-ঘাট, আলো-বাতাস, নদী-খাল, গাছ-পালা, পশু-পাথী তাদের কাছে এতো আপন যে; তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকিছুকে ভালোবেসে নিজের জীবন-যৌবন কাটিয়ে দেন এখানেই। তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস আর ঐতিহ্যর ধারক-বাহক হয়ে ভুলে যান দেশজোড়া তাঁর নিজের নাম ডাক তুলে ধরতে, অর্থের লোভকে দু’হাতে ঠেলে, ক্ষমতাকে পদদলীত করে, খ্যাতিরমোহকে পিছু ফেলে কিছু মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আপন করে নেন।
সদ্য পরলোকগত মুহম্মদ মুসা স্যার তেমনি একজন মানুষ। যিনি আপাদমস্তক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভালোবাসার মানুষ। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পবিত্র মাটিতে যার জন্ম, এর আলোবাতাসেই যার বেড়ে ওঠা, এ মাটিতেই তার চিরশয্যা। আলোকিত, বর্ণাঢ্য জীবনের আধিকারী তিনি। একজন মানুষ তাঁর সময়ের সবচেয়ে সঠিক যে কাজটি করা প্রয়োজন। মুসা স্যার সেগুলিই করে গেছেন। কৈশরে তিনি ভাষা আন্দোলনে সংযুক্ত হয়ে “ভাষা সৈনিক” হয়েছেন। তরুণ বয়সে ছাত্র নেতৃত্ব দিয়ে কলেজের ভিপি হয়েছেন। যৌবনে সংযুক্ত হয়েছেন সাংবাদিকতায়। পরিণত বয়সে হয়েছেন একজন শিক্ষক।
শিক্ষক হয়ে ছাত্র পড়িছেন, আলোকিত মানুষ গড়েছেন। সাংবাদিক হয়ে সাংবাদিকবৃন্দের নেতা হয়েছেন, অনেক গুণী সাংবাদিক তৈরী করেছেন তিনি। পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজে লেখালেখি করেছেন। লেখক-পাঠক তৈরী করছেন। বৃক্ষ প্রেমিক মানুষ ছিলেন তিনি।তাঁর হাতে লাগানো অনেক গাছ আজো ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সবুজ করে রেখেছে। ফল, ফুল, ছায়া দিচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরীর পেছনের সুনিপুণ পরিকল্পনা, বলিষ্ঠ হাত এবং সুক্ষ্ম কারিগর মুসা স্যার।
মুসা স্যারকে চেনন না ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এমনকোন বিশিষ্ট ব্যক্তি নেই। তরুণ প্রজম্মের কাছেও তিনি সমধিক পরিচিত। গত সত্তর বছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যত উচ্চপস্থ সরকারি কর্মকর্তা এসেছেন তাঁরা সবাই মুসা স্যারকে চেনেন। তাঁরা কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে স্মরণ করলে সাথে মুসা স্যার কেও স্মরণ করেন। যেন মুসা স্যার আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মানুষ অনেক ভাবে নিজেকে খ্যাতিমান করে তোলেনভ। তাদের জীবনে থাকে সুখ্যাতি আর দুখ্যাতি। মুসা স্যারের বেলায় শুধুই সুখ্যাতির পরিচিতি। এই যে এই মানুষটির এতো পরিচিত, জনপ্রিয়তা। তিনি কিন্তু নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে কোন ক্ষমতায় আধিষ্ঠ হতে চাননি। নিজের পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে অর্থের প্রাচুর্য সংগ্রহে ব্যস্ত হননি। তিনি সংগ্রহ করেছেন বই, বিলিয়েছন বই, বিলিয়েছেন জ্ঞান। বিলেয়েছেন ভালোবাস।
ব্রহ্মণবাড়িয়ার প্রিয় মানুষ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াপ্রেমী মানুষ মুসা স্যারের অমর সৃষ্টি “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিবৃত্ত” নামক বই সম্পাদনা। যা যুগ থেকে যুগের মেলবন্ধন রচনা করবে প্রতিটি ব্রাহ্মণবড়িয়া প্রেমিক মানুষের মাঝে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সূতিকাগার হয়ে থাকবে এই বইটি। আর মুসা স্যারও তাঁর সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আকাশে একটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। যে নক্ষত্র সদা প্রোজ্জ্বল্যমান।
(মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ-০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯খ্রি.)
বৃহৎ মানুষের সাথে ক্ষুদ্র স্মৃতি। (পর্ব-০২)
সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা স্যারের সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। ২০০৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। সে বছরই কলেজে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচি কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু করেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জনাব আবদুন নূর স্যার। সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন আমাদের শ্রেণী শিক্ষক, শ্রদ্ধেয় জনাব ওসমান গণী সজিব স্যার এবং সহকারি ছিলেন জনাব মোঃ আব্দুল হান্নান আংকেল।
প্রতি শুক্রবার ১০টায় কলেজের এল.টি কক্ষে ক্লাস ছিলো। এমনি একটি ক্লাসে একদিন সজিব স্যার মুসা স্যারকে অতিথি করে নিয়ে আসেন। ক্লাসের নিয়ম ছিলো আমরা বিগত সপ্তাহে যে বইটি পড়েছি সেটির উপর ১০টি ভালো লাগার লাইন ও ১০টি খারাপ লাগার লাইন উল্লেখ করে তার উপর আলোচনা লিখে আনা এবং ক্লাসে এসে মঞ্চে দাড়িয়ে সে বইটির আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখা।
সেদিন যে কয়েকজন বক্তব্য প্রদান করেছিলো তারমধ্যে আমিও ছিলাম। আমাদের সবার আলোচনা শেষে সজিব স্যার মুসা স্যারের পারিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের সাথে, যিনি এতোক্ষণ আমাদের আলোচনা শুনছিলেন। জনাব সজিব স্যার মুসা স্যারের যে পরিচিত আমাদের সামনে তুলে ধরলেন তাতে আমার মনে হলো তিনি যদি আমাদের বক্তব্যর আগে মুসা স্যারের পরিচয় দিতেন তাহলে আমরা হয়েতো নিজেদের বক্তব্য গুলি উপস্থাপন করতে পারতাম না।
সজিব স্যারের মুখে মুসা স্যারের পরিচিতি পেয়েই আমরা তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে যাই এবং মুসা স্যারের বক্তব্য শুনে তাঁর ভক্ত হয়ে যাই। সেদিন ক্লাস শেষে আমরা সবাই মুসা স্যার আর সজিব স্যারের সাথে এক সাথে বের হচ্ছিলাম। বের হতে হতে নানান কথার ফাঁকে মুসা স্যার আমার দেয়া বক্তব্যর প্রশংসা করলেন। গুণী মানুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আমি উনার প্রতি আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি।
তারপর থেকে স্যারের সাথে প্রায়ই দেখা হতো। কখনো তিনি অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ স্যারের রুমে যাচ্ছেন বা ফিরে আসছেন। কখনো নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলের দিকে যাচ্ছেন। কখনো ডাক বাংলার মোড় বা শহরের দিকে হাঁটছেন। স্যারের সাথে দেখা হলেই সালাম দিতাম, দু’কদম স্যারের সাথে হাঁটতাম। স্যার কুশলাদী জিজ্ঞাস করতেন। স্যারের সাথে কুশলাদীর উত্তর দিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতাম। একসময় এটা নিয়মিত হয়ে গেলো। স্যার যেহেতু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গবেষক তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে এটা সেটা প্রশ্ন করতাম। স্যার আগ্রহ নিয়ে একের পর এক গল্প আর ইতিহাস গুলি বলতেন।
নানান সময় মুসা স্যারের সাথে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মুখে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুনেছিলাম। শুনেছিলাম এই শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস। শুনেছিলাম অধ্যাপক হরলাল রায় স্যার, কবি আসাদ স্যার, অধ্যাপক এ.কে.এম হারুন অর রশিদ স্যার আর কবি আল মাহমুদ স্যারের নানা কথা। নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুল কিভাবে প্রতিষ্ঠা হলো, এটির নাম জর্জ মাইনর স্কুল বা কলেজিয়েট স্কুল কেন ডাকা হতো। স্যারের কাছেই শুনলাম যে মাঠটি আমরা কলেজ মাঠ নামে চিনি এটি আসলে কলেজের মাঠ নয়, এটি নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলের মাঠ। অবকাশ বা ফারুকী পার্ক প্রতিষ্ঠার গল্প। সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার কথা। কুরুলিয়া খাল বা এন্ডারসন খালের কাটার কথা। নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়াম আর এসডিওর মেলার কথা মুসা স্যারের কাছ থেকে আমার শোনা। আরো অনেক কিছু শুনেছি যার অনেকটিই আমার মনে নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে জানতে আমি একটু বেশি আগ্রহী ছিলাম, কারণ জন্মসুত্রে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান হলেও বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমরা সপরিবারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাহিরে ছিলাম। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। মুসা স্যার ছিলেন আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পর্কে জানার প্রথম ও সর্বত্তোম পাঠ এবং শিক্ষক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ উপলব্ধি করে একদিন তিনি কলেজের গেটে কাছে আমাকে দেখে ডাকলেন। বললেন ভাতিজা তোমাকেই খুঁজতে ছিলাম। স্যার আমাকে খুঁজছেন শুনে আমি ততধিক ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম, জি স্যার কেন খুঁজছিলেন। স্যার তখন নিজের হাতে থাকা একটি স্মরণিকা আমার হাতে দিয়ে বলেন, এই স্মরণিকাটা পড়বা, এইটা পড়লে তুমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক ইতিহাস আর ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে জানতে পারবা।
স্মরণিকাটি ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব থেকে প্রকাশিত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক খ্যাতিমান ব্যক্তি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি জনাব মনসুর কামাল সম্পাদিত “কালোত্তোর ব্রাহ্মণবাড়িয়া” শীর্ষক স্মরণিকা।এটি আজো আমার ব্যক্তিগত সংগহে আছে। এটি হাতে দেয়ার পর স্যার এটাও বলেছিলেন যে “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিবৃত্ত” বইটা আমার কাছে খুব বেশি সংখ্যক নাই, তুমি পাবলিক লাইবেরি বা সরকারি গণগ্রন্থগারে পাবে। আমি ওখানে কপি দিয়ে রেখেছি”।
মুসা স্যার একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন এই যে, শহীদ মিনারের পেছনের গাছগুলি দেখছ, এগুলি আমার হাতে লাগানো, ফারুকী পার্কের বড় বড় অনেক গাছ সহ শহরের অনেক স্থানে আমার হতে বা উদ্যোগে লাগানো গাছ আছে। কোন কোন স্থাপনা করার সময় কোন কোন গাছ কাটা পরেছে সেগুলিও তিনি অবলীলায় বলতে পারতেন। তিনি বলেতন শোন ‘তোমরা যে গাছের ছায়ায় বসে সময় কাটাও, ফুল ছেড়ো, ডাল ভাঙ্গ, এগুলি আমার সন্তানের মত আদর যত্নে বড় করা। কোন গাছ কাটা পড়লে আমি কষ্ট পাই। তোমরা সুযোগ পেলেই নিজে গাছ লাগাবে, অন্যদেরও গাছ লাগাতে বলবে। কারণ গাছ আমাদের অন্যতম বন্ধু। বই এবং গাছের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না’।
স্যারের সাথে আমার এই হাঁটতে হাঁটতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গল্প শোনা প্রায় বছর দেরেক ছিলো। স্যারের সাথে হাঁটতে দেখে আমার কয়েকজন বন্ধু একবার আমাকে বলেছিল মনির ঐ বুড়া লোকটা তোর কি হয়। অনেক সময় তাঁর সাথে তোকে দেখি। আমি স্যারের পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম দেখতে সাদামাটা এই লোকটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্রাহ্মবাড়িয়ার গবেষক, লেখক। আমি তাঁর কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস জানতে চেষ্টা করি।(মুসা স্যার সাদা-মাটা জীবনের অধিকারী হলেও তখনও “সাদা মনে মানুষ” খেতাবটি পাননি।) বন্ধুদের একজন মন্তব্য করেছিল এক কবি আরেক কবির দেখা পাইছস। (ততদিনে আমি বন্ধু মহলে কবি হিসেবে ছোট খাটো একটা পরিচিত পেয়েছিলাম।) বন্ধুর মন্তব্যর প্রতিউত্তোরে আমি বলেছিলাম “কার সাথে কার তুলনা করস, আমিতো তাঁর পায়ের ধুলো পাওয়ারও যোগ্য নই”।
একসময় আমি ভাবতাম স্যার আমাকে পেলেই কথা বলতে আগ্রহী কেনো। অনেক পরে এটার উত্তর জানতে পরেছি। মুসা স্যার আসলে আমার প্রতি নয়, তিনি এমন প্রত্যেক মানুষের সাথে কথা বলতে আগ্রহী যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জানতে চায়, যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভালোবাসে। কারণ তিনি নিজেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেমিক। মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ (০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি.)
বৃহৎ মানুষের সাথে ক্ষুদ্র স্মৃতি। (পর্ব-০৩)
সদ্য প্রয়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্যাতিমান ব্যক্তি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া গবেষক, ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাদা মনের মানুষ মুহম্মদ মুসা স্যারকে নিয়ে লিখতে লিখতে ভাবছিলাম কাজটি আমি ঠিক করছি কি না। কারণ জ্ঞানে, গুণে ও মানে মুহম্মদ মুসা স্যার আমাদের কাছে সমুদ্রসম। যে সমুদ্রের আমি জেলে, মাঝি বা নাবিক নই, সে সমুদ্রের গতীপ্রকৃতি, সভাব বা গভীরতা সম্পর্কে আমি কিইবা লিখতে পারব আর কতটুক লিখতে পারব। অর্থাৎ যে মুসা স্যার সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানিনা, যার সোনালী দিনের কর্মকান্ড গুলি আমি কাছ থেকে দেখব দূরের কথা সে সময় আমার জন্মই হয়নি, সেই ব্যক্তিকে নিয়ে লিখা কতটা যৌক্তিক বা বোধসম্পন্ন কাজ ।
পরে ভাবলাম আমি নাইবা হলাম ঐ সমুদ্রের জেলে, মাঝি বা নাবিক। একজন ভ্রমণ পিয়াসু দর্শক হিসেবে নিজের দেখা অভিজ্ঞতা বর্ণনাতো করা যেতেই পারে। একজন সাধারণ পর্যটক যেমন সমুদ্রের গভীরতা মাপতে পারে না, তেমনি মুসা স্যারকে নিয়ে লিখে আমি তাঁর যোগ্যতা বা গুণের সামান্যতম অংশও তুলে ধরতে পারবো না। আমি শুধু সে অংশটুকুই লিখতে চাচ্ছি তাঁর যতটুক স্মৃতি আমার কাছে আছে। অর্থৎ আমার এই লেখা শুধুই স্মৃতিচারণ মূলক, কারো কোন মূল্যায়ন নয়।
২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ও সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনায় শহিদ দিবস উদযাপন করা হবে। আমরা তখন দ্বিতীয় বর্ষে।আমরা মানবিক শাখার কয়েকজন বন্ধু সিধান্ত নিলাম শহীদ দিবস উপলক্ষে আমরা একটা দেয়ালিকা প্রকাশ করব। বিষয়টি আমাদের শ্রেনী শিক্ষক জনাব নজরুল ইসলাম স্যারকে জানানো হলে স্যার আমাদেরকে উৎসাহ দিলেন। জনাব সেলিনা ম্যাডাম, জনাব নুরে আলম সিদ্দিকি স্যার এবং জনাব নজরুল ইসলাম স্যারের তত্ত্বাবধানে আমাদের দেয়ালিকার প্রকাশের কার্যক্রম শুরু হলো।
স্যারদের নির্দেশে দেয়ালিকার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহের জন্য কলেজের নোটিশ বোর্ডে এর পাশে হাতে লিখা বিজ্ঞাপন লাগানো হলো, একাদশ শ্রেনীর প্রথমবর্ষ আর দ্বিতীয়বর্ষের প্রত্যেক শাখায় ঘোষণা দিয়ে আসা হলো। লেখা সংগ্রহ হলে নজরুল স্যার সেগুলি বাছাই করলেন। বন্ধু শামিম রেজার পীরবাড়ির বাসায় আমি, শামিম রেজা, মাহদুমুল হক, ওয়ালিউল্লাহ মাহমুদ, রিফাত বিন আইয়ুব সহ আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে রাত জেগে জেগে দেয়ালিকার কাজ করা হলো।
দেয়ালিকায় একটি লেখার জন্য আমরা মুসা স্যারের কাছেও আবদার করে ছিলাম। স্যার তখন বললেন দেয়ালিকার জায়গা ছোট, আমাদের লেখা নিয়ে জায়গা নষ্ট না করে ছাত্র-ছাত্রীদের দু-একটা লেখা বেশি নাও। আমরা বললাম ঠিক আছে স্যার, তাহলে একটা বানী দিয়েন। সেই দেয়ালিকায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ স্যারের বাণীর সাথে ভাষা সৈনিক মুসা স্যারেরও একটি বানী নেয়া হয়েছিলো।
২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরের আগেই দেয়ালিকাটি শহীদ মিনারের কাছা-কাছি স্থানে রেখে দেয়া হয়েছিলো। আর সেই দেয়ালিকা শহীদ মিনারে আসা আগত দর্শনার্থী, ছাত্র-ছাত্রীরা ও শিক্ষকবৃন্দ যারা দেখতে এসে ছিলেন তাদের মধ্যে মুসা স্যারও ছিলেন।সবাই দেয়ালিকার প্রসংশা করছিলেন। অনেই বলাবলি করছেন যে বহু বছর পর কলেজে এটা দেয়ালিকা প্রকাশ করা হলো।
আজ আমরা সেই সকল বন্ধুরা সারাজীবন এটা গর্ব করে বলতে পারিযে, কোন এক শহীদ দিবসে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আমাদের ক্ষুদ্র একটি সৃষ্টিশীল কাজে একজন ভাষা সৈনিক আমাদের পাশে ছিলেন। যা আমাদের কাছে চির গৌরবের। এর কয়েক মাস পর আমরা আরেকটি দেয়ালিকা তৈরী করেছিলাম দুটি দেয়ালিকাই প্রদর্শন শেষে কলেজের লাইব্রেরী রুমে রাখা হয়েছিলো।লাইব্রেরী রুমটি যথন আধুনিকায়ন করা হলো তখন দেয়ালিকা দুটি কোথায় রাখা হয়েছে আমাদের আর জানা নেই।
এর পরের মাস আমরা বিশ্ব সাহিত্যর বন্ধু মাহমুদ, রিফাত, হৃদয়, পাপেল, সাব্বির, সোহলে, সনি, তানজিনা, তন্বী, লিটাসহ আরো কয়েকজন মিলে সিধান্ত নিলাম কলেজে স্বাধিনতা দিবস উদযাপন করব। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রর সংগঠক ও আমাদের শ্রেণী শিক্ষক জনাব ওসমান গণী সজিব স্যারকে জানানো হলো। কিন্তু স্যার আমাদের এই বলে সতর্ক করলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। সব ধরনের সভা, সমাবেশ, গণ-জমায়েত নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় আমরা তোমাদের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিতে পারি না। কিন্তু তবুও আমরা সীমিত আকারে দিবসটি উদযাপন করতে চাইলাম। স্যার তখন বলেন ঠিক আছে তোমরা এল.টি রুমে অনুষ্ঠান না করে, শিক্ষক কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠান কর। আর আমি তোমাদের সরাসরি সহযোগিতা না করতে পারলেও পিছন থেকে সহযোগিতা করব।
কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকবেনা বলে আমরা কোন আর্থিক সহযোগিতাও পাবোনা। আমরা বন্ধুরা নিজেরা চাঁদা দিলাম এবং কলেজের বিভিন্ন বন্ধুদের কাছ থেকে দশ টাকা, বিশ টাকা করে চাঁদা উঠিয়ে সেই স্বাধিনতা দিবস অনুষ্ঠান আয়োজন করলাম। জনাব সজিব স্যারের নির্দেশনায় অনুষ্ঠানে তৎকালিন বিদায়ী প্রফেসর আবদুন নূর স্যার ও উপাধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা স্যারের সাথে মুহম্মদ মুসা স্যারও অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সেদিন মুসা স্যার মন্ত্রমুগ্ধর মত বক্তৃতা করেছিলেন। আর নূর স্যার দিয়েছিলেন তেজদীপ্ত ভাষণ। সেদিন তাঁরা সকলেই আমাদেরকে বিরুপ পরিস্থিতেও ভালোকাজ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।
সে সময়ের আরেকটি ঘটনা, একদিন সন্ধ্যায় ফারুকী পার্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়তে গিয়েছি। সেখানে মুসা স্যারও কি কাজে গিয়েছেন। সম্ভবত কোন বই খুঁজছিলেন। স্যারকে সালাম দিতেই বলেন তুমি কি এখানে বই পড়তে এসেছো। আমি বললাম স্যার, মাঝে মাঝে পত্রিকা আর ম্যাগাজিন গুলি পড়িতে আসি। স্যার বললেন বই পড়ো না? আমি বললাম সব বই সেলফে তালা দেয়া থাকে। ওনাদের সাথে পরিচয় নাই, তাই বই পড়া হয়না। তিনি বললেন এই কারণে তুমি বই পড়ো না! পত্রিকা পড়তে হবে, বইও পড়তে হবে। আমি বললাম স্যার এখানে বই না পড়লেও কাজিপাড়ার লাইব্রেরীতে বই পড়ি। (কাজীপাড়া-প্রয়াত ডাক্তার রফিকুল ইসলাম চেম্বারের দোতলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার ছিলো, যেটা এখন কুমারশীল মোড়) তখন স্যার বললেন চল তোমাকে পরিচয় করিযে দেই, তিনি আমাকে সেখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর থেকে সেখানেও মাঝে মাঝে বই পড়তে যেতাম।
ছোট বেলায় আব্বার সাথে যখন শহরে আসতাম তখন ফারুকী পার্কের সামনে যেতেই এই লাইব্রেরীটি দেখতাম। বড় বড় দুটি সাইন বোর্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইসলামিক সেন্টার। ২০০৩/০৪ সালের দিকে এক মাদ্রাসা পড়ুয়া বড় ভাইয়ের কাছে বললাম এটা আবার কি লাইব্রেরী কোনদিন খোলা দেখলাম না। ঐ বড় ভাই বললেন, আরে বোকা এটাতো প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোলে। তিনি একদিন সন্ধ্যায় আমাকে এখানে নিয়ে এলেন। ভাদুঘর আলিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক লাইব্রেরীর উপর তলায় অবিস্থিত ইসলামিক সেন্টারের দায়িত্বে ছিলেন। উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে উপরতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। দেখলাম সারি সারি আলমারীতে অনেক ইসলামী বই।
পরে আসলাম নিচ তলায়। এখানে এসেতো আরো অবাক। চারিদিকে বড় বড় অলমারিতে নতুন পুরাতন কত বই। সব নানান ভাগে ভাগে সাজিয়ে রাখা। মাজখানে বড় বড় কয়েকটা টেবিলে অনেক মানুষ পত্রিকা ম্যাগাজিন, বই পড়ছে। সেখানে একটি রেজিষ্টার ছিলো। নিজের নাম, ঠিকানা লিখে কি পড়ব বা পড়ছি তা লিখতে হতো। তারপর থেকে সেখানে যতবার গিয়েছি শুধু পত্রিকা বা ম্যাগাজিনই পড়েছি। এখানকার বই এখানে বসেই পড়া যায় তা জানি। কিন্তু সংকোচে কখনো তাদের কাছে বই পড়তে চাওয়া হয়নি। এর দু তিন বছর পর এবার এই লাইব্রেরীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ মুসা স্যার নিজেই আমাকে এখানে বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। যা আমার কাছে একটি স্মরণীয় স্মৃতি। (মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ-১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি.)
ছবি ক্যাপশন- ২০০৭ সালে এই স্মৃতিচারণ লেখার লেখক ও তার বন্ধুরা আয়োজিত স্বাধীনতা দিবেসের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা।
ছবি ক্যাপশন-২০১০ সালের কবির কলম আয়োজিত স্মৃতি সৌধে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা এবং এই স্মৃতিচরাণ লেখার লেখক মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ ও অন্যান্যরা।
আজ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২খ্রি. মুসা স্যারের তৃতীয় মৃত্যু বাষির্কী উপলক্ষ্যে তার বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। স্যারের সাথে আমার আরো বেশকিছু স্মৃতিচারণ আছে পর্যাক্রমে তা লিখবো আশা করছি।
এই লেখাগুলি তিন বছর আগে দেশদর্শন ডটকমে প্রকাশ হয়েছিলো। এবছর জনতার খবর ডটকম, আমার ব্লগ ও ফেসবুকে প্রকাশ করা হলো।