জনতার খববর ডেস্ক : কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা: যারা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করেন তাদের কাছে এই নামটি নতুন করে পরিচয় করে দেবার কিছু নেই। সাগরকন্যা কক্সবাজারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই মহামানবের কর্ম পরিধি সাগরের মতই সুবিশাল। শোণিতে সমুদ্রপাত, জন্মজাতি, মৈনপাহাড়, রাজার পোশাক, মাটির নিচে কাট কয়লা হাজার বছর কাতর, আমরা তামাটে জাতি, বার বছরের গল্প, তেলাপোকা, হাজার নদীর দেশ নামক নানা গ্রন্থে নিজের লেখার অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে জাতিসত্তার কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
প্রায় ছয় দশকের কর্মব্যস্ত জীবনে তিনি দেশের অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। দেশের প্রায় সব জেলাতেই রয়েছে তাঁর অসংখ্য সহকর্মী, অনুরাগী ও ভক্তবৃন্দ। ব্যতিক্রম নয় আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাও। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি রাজধানী বলে খ্যাত এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সঙ্গে তাঁর সংযোগ প্রায় অর্ধশত বছরের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে তার সুদৃঢ় বন্ধনের তথ্য অনুসন্ধান করতে সম্প্রতি শরণাপন্ন হয়েছিলাম কবি ও গবেষক শ্রদ্ধেয় জয়দুল হোসেন মহোদয়ের কাছে। তাঁর কাছেই জানতে পারি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে আশির দশকের শুরুতে একটি অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেছিলেন। এরপর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে তাঁর এক আত্মার বন্ধন রচিত হয়, রচিত হয় আত্মীয়তার বন্ধনও।
সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা কাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গত ৪৫ বছর তিনি এই মাটিতে নিজের পদচিহ্ন অঙ্কন করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তিনি যে সকল কাজ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৯৯-২০০০ সালে বছরব্যাপী আয়োজনে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন। তিনি তখন নজরুল গবেষণা ইনিস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও তখন মাসব্যাপী শুদ্ধস্বরে নজরুল গান ও কবিতা চর্চা প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেন তিনি।
সেসময় জেলা শিল্পকলা একাডেমি মাঠে দশ দিনব্যাপী নজরুল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল স্বরলিপি সমগ্র বইসহ এই মেলায় কবি নজরুল রচিত সকল বই তিনি পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসেন। মহৎ ও মহান এই কর্মযজ্ঞের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অধ্যাপক কে এম হারুনুর রশিদ স্যার। আহ্বায়ক ছিলেন ড. আহমদ আল মামুন, সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন কবি জয়দুল হোসেন। এছাড়াও বছর জুড়ে ছিল নানা আয়োজন।
দেশের লেখকদের একটি প্লাটফর্মে আনা এবং তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব। তিনি ৩১ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক লেখক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে প্রতিবছর বিভিন্ন জেলায় এই সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ সময় কবি জয়দুল হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা ও কবি জয়দুল হোসেন-এর যুগলবন্দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও রাইটার্স ক্লাবের অনেক অনুষ্ঠান বাস্তবায়িত হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেশ কিছু কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আয়োজন করেছিলেন। উল্লেখ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সন্তান, কবি শাহ মো: সানাউল হক গত মেয়াদে রাইটার্স ক্লাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
কবি জয়দুল হোসেন আরো বলেন, ২০০৯ সালে কবি মোহম্মদ নুরুল হুদার ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে ৬০ বছর পূর্তির জন্মোৎসব পালন করা হয়। এ উৎসবে দেশের অনেক খ্যাতনামা লেখকগণ উপস্থিত ছিলেন।
তিনি জানান, কয়েক বছর পূর্বে রাইটার্স ক্লাবের কেন্দ্রীয় একটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এ অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ নুরুল হুদা কে কবি শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এভাবেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানের ফলে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর কাছে পরিচিত ও অতি আপনজন হয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য এর আগেই তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর জামাই হিসাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর কাছ থেকে আলাদা সম্মান লাভ করেন।
১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই গুণী লেখক একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, সংগঠক ও দক্ষ প্রশাসক। প্রায় শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা ও বহু সাময়িকীর সম্পাদক-প্রকাশক এই কবি বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছেন আরো বহু আগেই। ফলে অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাঁকে নানা সম্মানে ভূষিত করেছেন।
এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে বাংলা কবিতায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ২০১৫ সালে প্রদান করা ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৮৫ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ সালে মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার’, কলকাতা উল্লেখযোগ্য। গত ১২ জুলাই ২০২১ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাঁকে তিন বছরের জন্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত করে। এরপর থেকে তিনি এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
বাংলা একাডেমির পরিচালক হওয়ার পরে গত মাসে তিনি আমাদের মাননীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি মহোদয়ের আমন্ত্রণে সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামে একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। আর গত ২০ এপ্রিল সদ্য অনুষ্ঠিত সাহিত্য একাডেমি আয়োজিত বৈশাখী মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানে শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদকে সাহিত্য একাডেমির বৈশাখী উৎসব সম্মাননা-২০২৪ প্রদান করেন। এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতী সন্তান, বাংলা একাডেমির একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক ড. নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর মহোদয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মোহম্মদ নুরুল হুদার বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপরেখা এবং কপিরাইট নীতিমালা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে তিনি আবারও সকলের মন জয় করেন। এ সময় তিনি একটি চমৎকার বৈশাখী কবিতা পাঠ করেন। যা উপস্থিত দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই হয়ত অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই এই কবিদের কবির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও ছবি তুলতে ভিড় করে। এ সময় আমি আমার সম্পাদিত শিশু-কিশোর সাময়িকী ‘কিচিরমিচির’ তাঁর হাতে তুলে দিই।
পরে তিনি আমাদের অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের স্টল পরিদর্শন করেন। এ সময় গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার সম্মানিত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আ. কুদদূস মহোদয় তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করেন। তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণ পাঠাগার নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা শেয়ার করেন। এছাড়াও আগামী বছর অদ্বৈত মেলার অতিথি হয়ে আসার অগ্রিম নিমন্ত্রণ প্রদান করেন। যা মোহাম্মদ নুরুল হুদা মহোদয় প্রফুল্লতার সাথে গ্রহণ করেন। এ সময় কবি জয়দুল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এসময় আমি আমার সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেতনার বাতিঘর’ সাময়িকীটি তাঁকে প্রদান করে কৃতার্থ হই। আমরা এই মহামানবের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
২৪ এপ্রিল ২০২৪