ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আল্লাহর পরম সন্তুষ্টিবিধানের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গের উৎসব। ইসলামের প্রধান উৎসবের দু’টো উৎসবের একটা এ ঈদ। একে বড় ঈদও বলা হয়ে থাকে। যা জিলহজ্ব মাসে পালন করা হয়। এ মাসেই মুসলমানরা পবিত্র হজ্বও পালন করে থাকে। ঈদের পরিসীমা যার কাছে যাই হোক না কেন অন্তত ঈদের দিনটি ধনী-গরীব সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করায় ঈদ। ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবাণী সকলের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ মর্মবাণী সকল অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরণা জোগায়। এ প্রেরণায় উদ্দীপ্ত সমাজের হতদরিদ্র অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মুসলমান হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব।
ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়, কর্ম নির্ভর ধর্ম। যার কর্ম শুদ্ধ নয়, তার ধর্মও শুদ্ধ নয়। ঈমান পাকাপোক্ত হয় সৎকর্মের মাধ্যমে। সৎকর্মে যারা আজীবন নিবিষ্ট থাকে তারাই সৃষ্টির সেরা। প্রবৃত্তির দাস কখনও আল্লাহ্র দাসে পরিণত হতে পারে না। ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়ে মানবতার সেবা এমনভাবে করতে হবে যেভাবে আল্লাহ্ আমাদের অনুগ্রহ করেন। শেখ সাদী (র.) বলেন, ‘তব তসবিহ এবং সিজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবে না, মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না।’
ঈদুল আজহা-কোরবানির ঈদ। আল্লাহর পরম সন্তুষ্টিবিধানের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গের উৎসব। ইসলামের প্রধান উৎসবের দু’টো উৎসবের একটা এ ঈদ। একে বড় ঈদও বলা হয়ে থাকে।
কোরবানি বা পশু উৎসর্গ মানুষের প্রাচীনতম ধর্মীয় আচারসমূহের একটি। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, মানুষ কৃষি সমাজে উত্তরণের পর ধীরে ধীরে এ ধারণা গড়ে উঠে যে, পশু উৎসর্গ করলে ফসল বাড়ে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে পশুর রক্ত মাঠে ছিটিয়ে দেওয়ার প্রথাও প্রবর্তিত হয়। শুধু পশু উৎসর্গ নয়, নরবলির মতো ঘৃণ্য কুসংস্কারও এ ধারণার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। সাধারণত কুমারী মেয়েদেরকেই বলি দেওয়া হতো।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) কোরবানির তাৎপর্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন। এ কোরবানি ফসল বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নয়, রিপু বলির প্রতীক, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে।
পবিত্র কুরআনে আমরা কোরবানির প্রথম উল্লেখ পাই আদিপিতা আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কাহিনীতে। একই পিতার সন্তান-সন্ততিই তখন পৃথিবীর একমাত্র মানবগোষ্ঠী। হাবিল ও কাবিলের মধ্যে তাই তাদের একজন সুন্দরী বোনকে বিয়ে করা নিয়ে রেষারেষি গড়ে উঠে। অবশেষে স্থির হয়, দুজনেই কোরবানি করবেন। যার কুরবানি কবুল হবে, তিনিই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন। তখনকার প্রথা অনুযায়ী আল্লাহর উদ্দেশ্যে শস্য মাঠের মধ্যে রেখে দিলেন দুই ভাই। হাবিলের শস্য স্বর্গীয় আগুনে পুড়ে গেল, মানে তাঁর কোরবানি কবুল হলো। পরবর্তী ঘটনার বর্ণনার অবকাশ এখানে নেই। এখানেও কোনো কোনো পন্ডিত উৎসর্গের সম্পর্ক কৃষি সমাজের সঙ্গে বলে দেখাতে চেয়েছেন। হাবিল কাবিল যে কৃষি সমাজের লোক ছিলেন, তা তো শস্য উৎসর্গ করা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। কুরআন হাদিসের সাক্ষ্যও এ মতের অনুকূলে।
উৎপত্তি যেভাবেই হোক, প্রাণী উৎসর্গ প্রাচীনতম ধর্মীয় প্রথাসমূহেরই একটি। ঈদুল আজহাও অনুরূপ একটি উৎসের উৎসব। তবে এ উৎসব প্রবর্তনের পিছনে জড়িত রয়েছে একটা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সুবিদিত ঘটনাটি আবার একবার বর্ণনা করা যাক সংক্ষেপে।
ব্যবিলনের ঊর প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম (আ.)। তিনি যুগপৎভাবে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের আদিগুরু। ইব্রাহিম (আ.) পিতা আজর ছিলেন মূর্তিনির্মাতা, মূর্তিব্যবসায়ী। ব্যবিলনের অধিবাসীরা ছিল মূর্তিপূজক। শুধু তাই নয়, তারা প্রকৃতির পুজোও করত। পয়গম্বর ইব্রাহিম (আ.) তাদের যুক্তি দিয়ে পরাস্ত করলেও তারা বল প্রয়োগে তাঁকে নিরস্ত্র করার চেষ্টায় লেগে যায়। এ সময় পারিবারিক অশান্তিও দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর মদদ কামনা করলে আল্লাহ তাকে আদেশ দেন পরম প্রিয়তমা পত্নী হযরত হাজেরাকে নিয়ে মক্কার মরু অঞ্চলে চলে যেতে। মক্কায় তখন জনমানব ছিল না। ছিল না কোনো শস্য বা জীবনধারণের উপযোগী সামগ্রী। এ দানাপানিহীন মরু বিয়াবানে প্রিয়তমা পত্নী ও সদ্যজাত শিশুপুত্র ইসমাইলকে রেখে আল্লাহর আদেশে ইব্রাহিম (আ.) আবার ফিরে গেলেন স্বদেশে। আবার যখন তিনি ফিরে এলেন মক্কায়, তখন ইসমাইল হেসে খেলে বেড়ানোর বালক। দানাপানিহীন বিয়াবানে আল্লাহর কৃপায় অলৌকিকভাবে পত্নী ও পুত্রকে বেঁচে থাকতে দেখে ইব্রাহিমের আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু এরই মধ্যে হয়ে গেল বিনা মেঘে বজ্রপাত। স্বপ্নে দেখলেন ইব্রাহিমকে আল্লাহ আদেশে করছেন, আমার উদ্দেশ্যে কোরবানি কর তোমার সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে। শেষ পর্যন্ত তিনি তার পুত্রকে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ইব্রাহিম (আ.) ডাকলেন ইসমাইলকে। মতামত চাইলেন তাঁর। যেমন ত্যাগী পিতা তেমনি সুযোগ্য পুত্র। উত্তর দিলেন, ‘আব্বা আমার, আপনি যে রকম আদিষ্ট হয়েছেন, সে রকমই করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে আপনি পাবেন ধৈর্যশীলদের একজন।’ ইব্রাহিম (আ.) এটাই প্রত্যাশা করছিলেন। পুত্রকে নিয়ে গেলেন মিনা ময়দানে। শোয়ালেন মাটিতে। পাছে পিতৃস্নেহ উথলে উঠে, সেই ভয়ে তিনি কাপড় বেঁধে নিলেন চোখের উপর। আল্লাহ আসলে চেয়েছিলেন, ইব্রাহিমের খোদাপ্রেম ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয়তম বস্তু কোরবানি করার মানসিকতা পরীক্ষা করতে। ইব্রাহিম এ পরীক্ষায় সফল হলেন। জিব্রাইলের মাধ্যমে ইসমাইলের স্থলে রাখা হলো একটা দুম্বা। ইব্রাহিম তাকেই জবেহ করলেন। প্রবর্তন হল কোরবানি উৎসবের।
জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে হজ যাত্রীরা কোরবানি করেন উট, দুম্বা অথবা ছাগল। ঐতিহাসিক সেই মিনা ময়দানে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা ছেড়ে মদিনায় যান, তখন মুসলমানরা একটা নতুন সমাজের মধ্যে হয় সুসংবদ্ধ, তখনই প্রয়োজন দেখা দেয় উৎসবের। আর তখন মোহাম্মদ (সা.) প্রবর্তন করেন দু’টো উৎসব। তারই একটি আরবদের আদিপিতা ইসমাইলের স্মৃতিতে ঈদুল আজহা।
ঈদ এমনিতেই মিলনের উৎসব, পবিত্রতার উৎসব, ত্যাগ ও মহত্মের উৎসব। ঈদুল আজহার তাৎপর্য হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইলের ত্যাগের স্পর্শে বেড়ে যায় আরো বহু গুণ। তবে হযরত ইব্রাহিমের জীবন ও আদর্শ এ ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে যে মহত্ব দান করেছে, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।
ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ ছিলেন আল্লাহর বন্ধু। পবিত্র কুরআনে রয়েছে, ‘স্মরণ কর, যখনই ইব্রাহিমকে তাঁর প্রভু যাচাই করলেন বিশেষ কয়েকটি ব্যাপারে এবং সে সবকটিতে উত্তীর্ণ হল তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতা করতে চাই। এ পরীক্ষাগুলোর একটি ছিল নমরুদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এতে উত্তীর্ণ হলেন। আগুনের উপরে বসে হাসলেন পুস্পের হাসি। তারপর এল স্বদেশ ত্যাগ করে মক্কায় গমন ও সেই দানাপানিহীন মরুবিয়াবানে পত্নী ও পুত্রকে বিসর্জনের আদেশ। তাও তিনি পালন করলেন। সর্বশেষে এল চরম পরীক্ষা পুত্রের কোরবানি। হাসিমুখে তাও সম্পন্ন করলেন। এমন যে অনুগত বান্দা, এমন যে প্রিয়তম মানুষ, তাকে যে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মর্যাদা দেওয়া হবে সে তো বলাই বাহুল্য। তাঁকে যে এত বড় মর্যাদা দেয়া হলো তার মূলে সবচেয়ে বড় জিনিস ছিল তাঁর ত্যাগ, তাঁর কোরবানি। ত্যাগ ছাড়া যে মহৎ হওয়া যায় না, ত্যাগ ছাড়া আসে না সফলতা, ইব্রাহিম (আ.) এ কথার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর হচ্ছে ধৈর্য ও সংযম। কী অপরিসীম ধৈর্য থাকলে মানুষ আগুনে ঝাঁপ দিতে পারে, পুত্রকে কোরবানি করতে উদ্যত হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
ইব্রাহিম (আ.) এ ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ইব্রাহিমই আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে পাপ থেকে পূণ্যের দিকে, অসত্য থেকে সত্যের দিকে যাত্রার নামই প্রকৃত ত্যাগ। অবশ্যই তিনি আক্ষরিক অর্থে দেশত্যাগ করেছিলেন সত্যের খাতিরে। আর এরই সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠিত হল পবিত্র কাবা, প্রবর্তিত হল মুসলমানদের বিশ্ব সম্মেলন, সাম্য ও মৈত্রীর পরাকাষ্ঠা হজ। তার সঙ্গে যুক্ত হল কোরবানি। প্রবর্তিত হল ঈদুল আজহা উৎসব। শিক্ষা পেলাম আমরা নিশ্চয়ই পশুর রক্ত বা মাংস আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে আমাদের নিয়ত, সংকল্প। কোরবানির মাধ্যমে আমরা আমাদের রিপু দমন ও ত্যাগের সংকল্পই ঘোষণা করি।
কোরবানি হলো পশুর সঙ্গে পশুত্ব কোরবানির নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে অনেকে অনেক মানসিকতায় কোরবানি করে যা সহজেই দৃশ্যমান হয়। কেউ কেউ লোকলজ্জায় নিজে কোরবানি না দিলে সন্তানরা গোশত পাবে কোথায়, আশপাশের অনেকেই কোরবানি দিচ্ছে আমি না দেই কীভাবে- এ ধরনের মানসিকতায়ও কোরবানি করে। এ ধরনের কোরবানি আল্লাহ তায়ালার দরবারে নাও পৌঁছাতে পারে। তাছাড়া অনেক বিত্ত-বৈভবের মালিককে কত দামের কোরবানি করবে সে প্রতিযোগিতায় শামিল হতে দেখা যায়। তাদের কাছে কোরবানি লৌকিক প্রথা হয়ে গেছে। লক্ষাধিক টাকায় গরু বা উট কিনে বাসার গেটের সামনে বেধে রেখে নিজ এলাকায় খ্যাতি অর্জনই অনেকের কোরবানির উদ্দেশ্য বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। এ ধরনের কোরবানি দ্বারা আত্মত্যাগ হয় না। ঈদুল আজহার দিনে পশু কোরবনির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হোক আমাদের জীবন। তা না হলে সামর্থ্যবান মুসলমানদের কোরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না। কোরবানি শুধুমাত্র একটি ইবাদতই নয় বরং কোরবানির মধ্যে রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের এক মহান দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ্ আমাদের সত্যিকারের কোরবানি করার তৌফিক দান করুন।
-আদিত্ব্য কামাল,বার্তা সম্পাদক জনতার খবর