ঈদ মানে খুশি ঈদ মানে আনন্দ। এই কথাটি আমরা সবাই জানি। বড় হওয়ার পর মনে হয় ছোটবেলার ক্ষেত্রে এ কথাগুলো একদম পারফেক্ট ছিল। বড় হওয়ার পর ঈদ উদযাপনে অন্যরকম হয়ে যায়।
ছোটবেলার সবকিছু ছিল আজকের এ সময়ের তুলনায় অন্যরকম মজার। বিশেষ করে ঈদ মানে তো অন্যরকম এক আনন্দ। ছোটবেলার ঈদের খুশি আর আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না বলেও বোঝানো যাবে না। এ আনন্দের রেশ থাকত ঈদের কয়েকদিন আগ থেকে কয়েকদিন পর পর্যন্ত। ঈদের দিনের ভালা লাগা ছিল অতুলনীয়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ স্মৃতিকাতর হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে স্মৃতির পাতাগুলো একটু ঝাপসা হয়ে এলেও মন থেকে একেবারে মুছে যায়না। টুকরো টুকরো হয়ে মনের কোনে জমে থাকে। সময়ে-অসময়ে নস্টালজিয়ায় ভোগায়!
ঈদ নিয়ে আমার তেমনই কিছু স্মৃতি আছে যা কখনো ভুলতে পারবোনা। আমি মাঝে মাঝেই সেসব স্মৃতি রোমান্থন করে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠি।
ঈদ শব্দটা শুনলেই মনে আনন্দ লাগে। হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এ শব্দটা আনন্দের আলাদা মাত্রা বহন করে। যে মাত্রা অন্য কোনো শব্দে রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ আয়োজন হলো ঈদ উৎসব। ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ এ উৎসবে শামিল হয়। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যে যার সাধ্যমতো খুশিতে মেতে ওঠে। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র দুটি দিন মুসলিম ধর্মের এ উৎসবের নাম ঈদ। এর একটি ঈদুল ফিতর ও অপরটি ঈদুল আযহা। উৎসব দুটির পেছনে রয়েছে মুসলিম ধর্মের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণমুখী কাজ ও ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। যখন রোজা থাকতাম না, তবুও ইফতারের আগে বসে পড়তাম ইফতার নিয়ে। বাবা, মা, ভাইয়ের রোজা থাকার কারণে আজানের অপেক্ষা করতো। আর আমি তো আগেই খাওয়া শুরু করতাম। তখনও বুঝিনি ইফতারের যথার্থ মর্ম। কিন্তু এখন বুঝতে শিখেছি এবং রোজা রাখতে শিখেছি।
শৈশবের রোজা রাখার বিষয়টি খুবই আনন্দের। ইসলামে যদিও বালেগ বা ১২ বছরের পর হতে রোজা ফরজ করা হয়েছে। রোজা নিয়ে অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। বয়স কম বলে রাতে সাহরি সময় উঠাতো না। বাবা-মা ভাইয়েরা যখন সাহরি খাওয়া শুরু করতেন তখন বিছানায় এদিক-ওদিক মোড়ামুড়ি করতাম, আমিও ভাত খাবো বলে কান্না করতাম, প্রস্রাবের ভান করে জেগে যেতাম। এভাবে সাহরি খেতে উঠতাম। বাবা-মা ভাইদের শর্ত ছিলো খাও, তবে ভেঙ্গে-ভেঙ্গে রোজা রাখবা। আবার জ্ঞান দিতো ছোটরা দিনে ২/৩টা রোজা রাখতে হয়। সব শর্ত মেনেই খেতাম।
ছোট বয়সে ঈদ আসলেই নতুন জামা কেনার জন্যে পাগল হয়ে যেতাম। বাবাকে নতুন জামার অর্ডার দিতাম। নতুন জামা ছাড়া যেনো ঈদ হবেই না। বাবার সাথে মার্কেটে যেতাম। পছন্দ মতো জামা, জুতা কিনে নিয়ে আনতাম। বাড়ির সমবয়সীদের রাতেই ঈদের জামা দেখাতাম। এতে খুব আনন্দ লাগতো।
ছোটবেলায় বিশ রোজার পর অপেক্ষা থাকত কবে ২৯ রোজা আসবে, চাঁদ উঠবে। দোয়া করতাম যেন কোন মতেই ঈদ ৩০ রোজায় না হয়। কারণ ২৯ রোজায় চাঁদ ওঠা একটা অনিশ্চয়তার ব্যাপার, আর তাই মজার। ইফতার করতে পারতাম না সেদিন, পানি আর দুই একটা জিনিস মুখে দিয়েই দৌড়। পিছন পিছন আম্মা বলত, এই দাঁড়া, দাঁড়া। কে শোনে?
ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি বলতে কখন রেডিওতে ঘোষণা দিবে যে চাঁদ দেখা গিয়েছে আগামীকাল ঈদ। তারপর রেডিওতে সেই চিরচেনা গান শোনা, ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’…
আমাদের ছোট বেলায় ঈদের চাঁদ দেখার একটা ব্যাপার ছিল। এখন যেমন শুধু চাঁদ দেখা কমিটিই চাঁদ দেখে আর কেউ দেখে বা দেখার আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমাদের ছোট বেলায় ঈদের চাঁদ দেখা একটা মিশন ইম্পসিবলের মতো ব্যাপার ছিল যা শেষ পর্যন্ত আমরা পসিবল করে ছাড়তাম। কে কার আগে চাঁদ দেখেছে এবং কীভাবে দেখেছে এর একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত সবার মধ্যে। আকাশে খালি চাঁদ উঠলেই হবে না। সেই চাঁদ আমাদের দেখতেই হবে। নইলে পরের দিন যেন ঈদই হবে না।
এখন তো সবাই ফেসবুকে চাঁদের তালাশ করে। ছোটবেলায় চাঁদ দেখার মাঝে যে কী আনন্দ ছিল, এখনকার ছেলেমেয়েদের বোঝানো যাবে না। চাঁদ দেখামাত্রই খুশির মিছিল বের হতো। আমিও শরিক হতাম তাতে। দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজিও ফোটানো হতো।
চাঁদ উঠলে আমর আরেকটু বড় ভাইরা ডেক সেটে গান ছাড়ত, মসজিদে মসজিদে আল্লাহু আল্লাহু ধ্বনি, অসাধারাণ সেই সুর, কিছুক্ষন পর পর হুজুরের জানিয়ে দেয়া ঈদের জামাতের সময়। বাসা বাসা থেকে আসত রান্নার গন্ধ।
চাঁদ দেখার পর ওই রাতেই কাগজ কলম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তাম ঈদকার্ড বানাতে। নারকেল গাছের আড়াল দিয়ে উকি দিচ্ছে কাস্তে বাকা চাঁদ। পিছনে একটা রকেট! (আসলে রকেট না মসজিদের মিনার অঙ্কন শিল্পের গুনে রকেট মনে হচ্ছে)। সেই কার্ড আবার সেই রাতেই বন্ধুদের কাছে পৌছাতে হবে। না পৌছাতে পারলে যেন ঈদই মাটি!
ঈদের চাঁদ দেখে ঈদ নিশ্চিত করার পর আতশবাজি খেলায় মেতে উঠতাম পাড়ার সবাই মিলে। আর রাত জেগে হাতে মেহেদি লাগাতাম। শৈশবের মেহেদি আর বর্তমানের মেহেদি এক মেহেদি নয়। তখন মেহেদি গাছের মেহেদি নারিকেল পাতার শলা দিয়ে হাতে লাগাতাম। আর এখন সবাই কেমিক্যালের তৈরি মেহেদি লাগায়। মেহেদি লাগানোর জন্যে বাড়ির আন্টি বা ভাবি কিংবা আপুদের বাসায় বাড়ির সব পোলাপান গিয়ে ভিড় জমাতাম। সিরিয়ালে একের পর এক লাগাতে লাগাতে ভোর রাত হয়ে যেতো। তারপর বাসায় ফিরলে মায়ের বকুনিও শুনতে হতো।
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা। কেন জানি তখন এমনিতে সকালে ঘুম ভেঙে যেত। হয়তো আনন্দ উত্তেজনার কারণে। তাড়াতাড়ি গোসল করে নতুন জামা পরতাম, তারপর অপেক্ষা করতাম কখন বড়’রা নামাজে ঈদগাহে সাথে নিয়ে যাবে, তারপর তাদের থেকে ঈদের সালামি নেয়া।
নামাজের পর শুরু হতো আসল ঈদ। বাসায় ফিরে পাজামা পাঞ্জাবি বদলে ঈদের জামা জুতা পরে ছুট বন্ধুদের সাথে বাসায় বাসায়। প্রত্যেক বাসায় খাওয়া জরুরি। কে কটা বাসায় খেল এটাও এক প্রতিযোগিতা যেন। আর বাসার খালাম্মারাও না খাইয়ে ছাড়তেন না।
আসলে আমাদের ছোট বেলার ঈদ এতই আনন্দের হতো যে দম ফেলার সময় হতো না। যেন দম ফেললেই দু-একটা ছোটখাট আনন্দ মিস করে যাব। একেক সময়ে একেক আনন্দ। সকালে এক আনন্দ দুপুরে আরেক রকমের আনন্দ বিকেলে আরেক ধরন… আর সন্ধ্যায় সবচে বড় আনন্দ … বড় ভাইদের তত্ত্বাবধানে পাড়ার কোনো বাসার বারান্দায় স্টেজ করে বিচিত্রানুষ্ঠান। তখন আশপাশে কোনো বাসায় টিভি ছিল না। টিভি কী বস্তু জানতামই না। তাতে আমাদের আনন্দ কিন্তু কিছু কম হতো না। এই বিচিত্রানুষ্ঠানই আমাদের চাররঙা বিয়াল্লিশ ইঞ্চি টিভি যেন। সেখানে নাটক হতো গান হতো নাচ হতো… কত আনন্দই না হতো। আমরা ছোটরাও মাঝে মধ্যে অভিনয় করার সুযোগ পেতাম।
ব্যাপারটা এমন নয় যে আগে ছোটবেলার ঈদে অনেক আনন্দ ছিল এখনকার ছোট বেলার ঈদে আনন্দ কম তা নয়- এখন বরং আনন্দ আরো বেশি। টিভিতে কতরকম অনুষ্ঠান থাকে, ঈদ সংখ্যা পত্রিকায় কত রকম লেখা থাকে, পোশাক আশাক তো আছেই, সেলামি বাণিজ্যও বাচ্চাদের জন্য কম আনন্দের না।
ঈদ ছোট-বড় সবার কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে। শৈশব, কৈশোর, যুব, বৃদ্ধ কোনো বয়সেই ঈদের খুশির আলাদা পার্থক্য থাকে না। সবার মনে ঈদের আকর্ষণ কাজ করে। ঈদ মনকে দেয় আলাদা সতেজতা। ছোট-বড় সবাই যার যার অবস্থান থেকে ঈদকে হৃদয়ে গেঁথে নেয় এবং সকলের সাথে সমানতালে বিনোদনে শামিল হয়। তবে সবার জীবনই শৈশব দিয়ে শুরু। তাই শৈশবের ঈদ হৃদয়ে আলাদা জায়গা করে নেয়। শৈশব বলতে আমি সাধারণত বুঝি জন্মের পর থেকে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই শৈশবের ঈদের স্মৃতি রয়েছে। পরিবেশ, অবস্থা ও পরিবারবেধে এই স্মৃতিতেও আছে তারতম্য। আমি অনেকটা গ্রামের ছেলে। শহরের ঈদের চেয়ে গ্রামের ঈদে শৈশব কাটানো আমার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। গ্রাম্য পরিবেশে শৈশবের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার যতটুকু বিনোদন ছিলো আর বর্তমানে যা যা মনে আছে, তার সবটুকুই এ লেখায়।
আমাদের ঈদ শেষ হতো কান্না দিয়ে। গভীর রাতে আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই কান্না শুরু করতাম। ঈদ শেষ হয়ে যাওয়ার কান্না। তারপর আর কি, কোরবানি ঈদের স্বপ্ন নিয়ে হাসি মুখে ঘুমাতে যেতাম।
এখন আর ছোট নেই, আমি বড় হয়েছি, আর বাব-মা হয়েছে ছোট। এখন অনেক দায়িত্ব। তবুও মাঝে মাঝে খুব ছোট হতে ইচ্ছা করে আবারো।
সব ঘটনাই ছিলো শৈশবের ঘটনা। সময় বয়ে যায়। ঘটনা প্রবাহের তার চিত্র পরিবর্তন করে। শৈশবের সেই ঈদ আনন্দ আর বর্তমান সময়ের ঈদ আনন্দের মাঝে এখন বিস্তর ফারাক। অনুভূতিগুলো বেশ বৈচিত্র্যও বটে।
এখনো ঈদে অনেক আনন্দ আছে, অন্যরকম এবং দায়িত্বের, ছোট বেলার সেই বল্গাহীন আনন্দটা নেই। তবে সেজন্য আমি দুঃখিত নই এতটুকুও, মাঝে মাঝে নস্টালজিক হয়ে যাই এই আর কি।
শৈশবের ঈদ-স্মৃতি লেখতে গেলে এর যেনো শেষ নেই। আমাদের জীবনে শৈশব আর কখনোই ফিরে আসবে না। এটা কালের বিবর্তনেরই অংশ। বর্তমানে যে যার অবস্থানে আছি সবার মাঝেই কমবেশি শৈশবের স্মৃতি রয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো স্মৃতিচারণ করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুরোনো সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করে আগামীর অপসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকতে পারবে। শৈশবের ঈদ-স্মৃতি খুব মনে পড়ে। এখন কেমন যেনো সব আনন্দেই ভাটার টান। আগের মতো করে আর আনন্দ হয় না ঈদে। বাস্তবতার চাপে সবই যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় বড্ড ভালো ছিলো আমাদের ছোটবেলা। এখন আর ছোটবেলার মতো আবেগ নেই। সবকিছুই মনে হয় যান্ত্রিক, আবেগহীন ও অনুভূতিশূন্য।
এখন বড় হয়েছি। এখনও ঈদের সময় সে একই ঈদগাহে যাই। নামাজ পড়ি। পরিচিত জনদের সঙ্গে কোলাকুলি আর কুশল বিনিময় করি। সব মানুষের জন্য দোয়া চাই সৃষ্টিকর্তার কাছে। সেই মাঠের কাছ দিয়ে গেলে এখনও ছোটবেলার স্মৃতিরা ভিড় করে মনে। ফিরে যাই সে সময়ে যখন নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো দায়িত্ব বা কর্তব্য মাথায় ছিল না। নিজেকে নিয়েও এত চিন্তা ছিল না তখন। ইচ্ছা করলেও এখন আর সে অবস্থায় ফেরার সুযোগ নেই, পারবও না। ভালো থাকুক আমার ছোটবেলা।
– আদিত্ব্য কামাল। বার্তা সম্পাদক,জনতার খবর