উদ্বোধনের পর রোববার (২৬ জুন) থেকে যান চলাচল শুরু হয়েছে পদ্মা সেতুতে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সেতু চালু হওয়ার উচ্ছ্বাস এখন সারা দেশে। কিন্তু সেতুটি উদ্বোধনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত যখন দেশ-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রে, ঠিক তখনই দেখা দিয়েছে কিছু অসঙ্গতি-বিশৃঙ্খলা।
পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তায় সরকারি নির্দেশনা মানছেন না অনেকেই। কৌতূহল থেকে সেতুটি দেখার জন্য দলে দলে সেখানে ভিড় করছে মানুষ। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ বানাচ্ছেন টিকটক ভিডিও। তবে এর মধ্যেই আবার পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলে নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় সেতুটির নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
পদ্মা সেতুতে দাঁড়ানো বা ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ শনিবার (২৫ জুন) কিছুটা নমনীয় অবস্থানে ছিল সেতুটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মীরা। কিন্তু সেই সুযোগেই সেতুতে দেখা যায় নিয়ম ভাঙার হিড়িক। গাড়ি থামিয়ে কেউ তোলেন ছবি, আবার কেউ সেতুর ওপর দাঁড়িয়েই করেছেন টিকটক ভিডিও। তেমনই এক টিকটক ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে এক টিকটকারকে পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলে ফেলতে দেখা যায়।
কাইসার ৭১ (Kaisar71) নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্টের লোগো লাগানো ৩৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, এক যুবক পদ্মা সেতুর ওপর লোহার রেলিংয়ের দুটি নাট খুলছেন। এরপর সে নাট দুটি বাঁহাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ডানহাতে নেন এবং আবার বাঁহাতের ওপর রাখেন।
নাট দুটি খুলে হাতের ওপর রেখে ওই যুবক বলেন, ‘এই হলো আমাদের পদ্মা সেতু। আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু্।’ এ সময় পাশ থেকে আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘নাট খুলে ভাইরাল করে দিয়েন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিকটক ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা। ওই যুবকের এমন কাণ্ড দেখে অনেকেই তার শাস্তি দাবি করেছেন। ফেসবুকে ওই ভিডিওর নিচে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, ‘প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই দেশদ্রোহীকে আইনের আওতায় নিয়ে শাস্তি দেয়া হোক।
আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, ‘প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি এই ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হোক। আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষার্থে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হোক। যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, ‘বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে পদ্মা সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তবে জাতীয় এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা নিয়ে এ ধরনের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের পর চুপচাপ বসে থাকেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পদ্মা সেতুর রেলিংয়ের নাট-বল্টু খুলে টিকটক বানানো সেই যুবককে দ্রুত সময়ের মধ্যে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
রোববার (২৬ জুন) সন্ধ্যায় সময় সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা। পদ্মা সেতুর রেলিংয়ের নাট-বল্টু খোলা ওই যুবকের নাম বায়েজিদ তালহা বলে জানান তারা।
সিআইডির সাইবার ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ গণমাধ্যমকে জানান, টিকটকার তালহাকে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে রোববারও (২৬ জুন) চরম বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে পদ্মা সেতুতে। এদিন বিকেলে হঠাৎই হাজার হাজার মোটরসাইকেল আরোহী জড়ো হন সেতু এলাকায়। টোল প্লাজার সামনে একযোগে হর্ন দিয়ে, বিভিন্ন স্লোগানে ও হৈ হুল্লোড় করে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন তারা।
পিকআপ ভ্যানে করেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসছে। সবার মাঝেই পদ্মা সেতুতে ওঠার এক দারুণ উন্মাদনা। কেউ কেউ টোল প্লাজা পেরিয়ে এসে মোটরসাইকেল দাঁড় করাচ্ছেন। তাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
সেতু চালু হতে না হতেই জরিমানার ঘটনাও ঘটেছে। পদ্মা সেতু দেখতে গিয়ে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জরিমানার মুখে পড়েছেন আয়উব খান নামে এক মোটরসাইকেল চালক। তিনি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। হেলমেট না থাকায় রোববার (২৬ জুন) দুপুর সোয়া ২টার দিকে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজায় তাকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর আগে জাজিরা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে হাবিবা ফারজানা জানিয়েছিলেন, সোমবার (২৭ জুন) থেকে পদ্মা সেতুতে নেমে ছবি তুললে বা গতিসীমা না মানলে জরিমানার মুখে পড়তে হবে। তবে নাট-বল্টু খুলে নেয়া, গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা, টিকটক ভিডিও করাসহ অন্য সব অনিয়মের খবর সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করায় রোববার (২৬ জুন) সন্ধ্যা থেকেই সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন অ্যাকশন নেয়া শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
উদ্বোধনের পর থেকেই গাড়িতে, বাসে কিংবা মোটরসাইলে কে প্রথম পদ্মা সেতু পাড়ি দিল তা নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। এমনকি লেডি বাইকার বা নারী মোটরসাইকেলচালক হিসেবে কে প্রথম পদ্মা পাড়ি দিয়েছে, প্রকাশ হয়েছে সেই খবরও।
বিশৃঙ্খলার মাঝেই গাড়ি থেকে নেমে এক যুবকের পদ্মা সেতুর ওপর প্রস্রাব করার একটি ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনার পর ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে মজার ছলে অনেকে লেখেন, ‘এই হলেন পদ্মা সেতুতে প্রস্রাব করা প্রথম ব্যক্ত ‘, বা ‘পদ্মা সেতুতে প্রথম প্রস্রাব করা ব্যক্তিকে পাওয়া গেল।’ তাকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি করেছেন অনেকে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করা পদ্মা সেতু এখন বৈশ্বিক পরিবহন অবকাঠামোতে প্রকৌশলগত উৎকর্ষ ও অর্জনের প্রতীক। সেতুটি দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় অন্যতম মাইলফলকও বটে। অর্থনীতিবিদ ও প্রকৌশলীরা বলছেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে; ভবিষ্যতে তা হতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম বড় সম্পদ। ফলে নির্মাণকাজ সফলভাবে সম্পন্ন শেষে এখন পদ্মা সেতু যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সেরা সব উপকরণ। কনসালটিং প্যানেলের অনুমোদন ছাড়া ঠিকাদারকে এ প্রকল্পে কোনো উপাদান ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। ফলে সেতুটি ১০০ থেকে ১২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দেশিকা জারি করার কথা উল্লেখ করে এর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এই সেতুটির স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছরেরও বেশি।’