দয়া, ক্ষমা, বিনয়, সরলতা, শিষ্টাচার, সাধুতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মসংযম ইত্যাদি সদ্গুণ শুধু মানুষের ভেতরে পরিলক্ষিত হয়, অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে তেমনভাবে নয়। এ জন্য মানুষ অন্য সব সৃষ্টি থেকে আলাদা। মানুষের এত গুণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ। শিষ্টাচার মানবজীবনের অলংকার। সুন্দর আদব-কায়দা প্রত্যেক মানুষের অমূল্য সম্পদ। জীবনকে সঠিক ও যথার্থভাবে বিকশিত ও উপভোগ্য করার জন্য শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধের বিকল্প নেই। যার মধ্যে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ রয়েছে সে নিজেকে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। সমাজে প্রতিনিয়ত আমাদের নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে পারস্পরিক আচরণে সুষ্ঠু রুচিবোধ, ভদ্রতা, নম্রতা ইত্যাদি প্রকাশ পেলে মানবিক সম্পর্ক সুন্দর ও নিবিড় হয়ে ওঠে। এ জন্য মানবজীবনে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম।
আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় বিনয়, নম্রতা আর সৌজন্যের প্রকাশকে শিষ্টাচার নামে অভিহিত করা হয়। অন্যকথায় বলা যায়, মানুষের দৈনন্দিন চলা-ফেরা, কথাবার্তা ও তার বাহ্যিজিক দিকটিকে বলা হয় শিষ্টতা। আচরণে মার্জিত না হলে, ব্যবহারে উগ্রতা পরিহার না করলে মানুষ শিষ্টাচারী হতে পারে না। স্বভাবে দাম্ভিকতা ও কর্কশতা পরিহার করতে না পারলে মন মাধুর্যময় হয় না।
মানবিক সত্তা যতই চরিত্রের মাধুর্য অর্জন করে ততই সে হয়ে ওঠে স্বভাবে শিষ্ট। শিষ্টতা ব্যক্তির আচরণকে করে মার্জিত, বাচনকে করে সৎ ও সুললিত। শিষ্টাচারহীন মানুষ সবসময় উদ্ধত থাকে। তার আচরণে প্রাধান্য পায় অবজ্ঞা, ঔদ্ধত্য, দুব্যবহার ও দুর্মুখতা। অহংকার অন্যকে ছােট ভাবতে প্ররােচিত করে কিন্তু শিষ্টতা মানুষকে সম্মান করতে প্রণােদনা দেয়। ভালো উত্তম আচরণই বলে মানুষটি কেমন। শিষ্ঠতার পরিচয় শুধু তার বাহ্যিজিক দিক নয় বরং অন্তরের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলনে শিষ্ঠতার পরিচয় ফলে। কারণ মানুষ সৃষ্টিগত কারণেই মনের চিন্তা ভাবনাগুলোকে তার ভিতর থেকে বাহিরে প্রকাশের জন্যে উদ্বত্ত হয়।
সমাজকে সুন্দর ও উন্নত করার জন্যে শিষ্ট আচরণ অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব তাই তাকে সমাজে অন্য মানুষের সাথে চলা-ফেরা করতে হয়। যদি তার চলা-ফেরায় শিষ্টতা না থাকে তাহলে সে পশুর সমান হয়ে যায় আর তখনই সমাজে দেখা দেয় নানান বিশৃঙ্খলা। অপরপক্ষে শিষ্ট ব্যবহার সমাজকে করে সুন্দর। শিষ্ট ব্যবহার দিয়ে মানুষের মন ও আস্থা অর্জন করা যায় এতে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
একজন মানুষের স্বভাবে আলাের দীপ্তি দেয় শিষ্টাচার । সে আলাে ব্যক্তি তথা পরিবার থেকে ছড়িয়ে পড়ে গােটা সমাজে, রাষ্ট্রে। এ আলােতে উজ্জ্বল ব্যক্তির আত্মিক মুক্তির সাথে যােগ হয় মানবিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি। শিষ্টজন তার সৌজন্য আর বিনয়ের মাধ্যমে সকলের প্রিয়তা অর্জন করেন, অর্জন করেন অন্যের আস্থা। অন্যের সহানুভূতি, প্রীতি ও সম্মান লাভ করার জন্যে শিষ্টজনই উত্তম। তাই সামাজিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্যে শিষ্টাচারের বিকল্প নেই। এতে করে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সকলের আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজ হয় শান্তি ও সম্প্রীতির।
নিষ্ঠা, অভিনিবেশ আর শৃঙ্খলাবােধের পাশাপাশি জীবনে শিষ্টাচার অনুশীলন খুবই জরুরি। সৌজন্য ও শিষ্টাচারের ছোঁয়াতেই একজন মানুষ হয়ে উঠে বিনীত ও ভদ্র। কোনাে মানুষের কাছে অমার্জিত রূঢ় ও দুর্বিনীত আচরণ কখনাে কাম্য নয়। শিষ্টাচার ও সৌজন্য মনুষ্যত্ব অর্জনের সােপান। সৌজন্য ও শিষ্টাচারের অভাব ঘটলে জীবন থেকে ভালােবাসা, মমতা, সহানুভূতি, বিনয় ইত্যাদি হারিয়ে যায় । সে হয়ে ওঠে দাম্ভিক, স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর। তাই নিজেদেরকে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী করতে হবে। নৈতিক চরিত্রের উৎকর্জষের জন্যে তাই শিষ্টতার সম্মিলন ঘটানাের কোনাে বিকল্প নেই।
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিষ্টাচারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তা না হলে সমাজে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, অন্যায়, মারামারি-হানাহানি, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা। শিষ্টাচারের অভাব হলে সমাজ হয়ে উঠে প্রীতিহীন। গোটা সমাজ আচ্ছন্ন হয়ে যায় হিংসা-বিদ্বেষ আর অশান্তিতে। তাই সমাজে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। শিষ্টাচারের অভাবে সমাজে সৌন্ধর্য আর সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রেম-প্রীতি ও মমতার অভাবে মানুষ হয়ে পরে বিচ্ছিন্ন, স্বার্থনেষী ও আত্মকেন্দ্রিক। আর এই শিষ্টাচারহীন অন্তঃসারশূন্য বিবেকহীন সমাজকে বিবেকবোধে জাগ্রত করতে পারে একমাত্র সুন্দর ব্যবহার শিষ্টতা।
শিষ্টচার যে শুধু সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব অনেক। জাতীয় জীবনে শিষ্টাচারের প্ৰকাশ পায় পায় রাষ্ট্র পরিচালনায়। একটি দেশ পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, নেতা, কুটনৈতিকবিধদের মধ্যে শিষ্টচারের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র জীবনে শিষ্টাচারের প্রভাব পরে গোটা দেশজুড়ে।
শিষ্টাচার শিখার অনন্য মাধ্যম হলো ধর্মীয় শিক্ষা। একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে সৎ চরিত্রের অধিকারী করতে। প্রতিটি ধর্মেই শিষ্টাচার শিখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বিশেষ করে মুসলিম ধর্মে বলা হয়েছে মানুষের সাথে সৎ ব্যবহারের কথা। যার হৃদয় যত পবিত্র ও কলুষমুক্ত- তিনি তত কোমল ব্যবহারের অধিকারী হন, তিনি হন সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা অধিকারী।
এমনি এমনি শিষ্টাচার মানব হৃদয়ে জন্ম নেয় না। একে অর্জন করে নিতে হয়। এ জন্যেই শিষ্টাচারের চর্চা শুরু করতে হবে শিশুকাল থেকে। শৈশবে সৌজন্যবোধের পাঠ নিলে ভবিষতে শিশু মার্জিত স্বভাবের অধিকারী হয়। তাই শিশু কোন পরিবেশে, কার সহচর্যে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু শিষ্টাচারের পাঠ পায় তার পরিবার থেকেই। তাই অভিবাবকদের নিন্মলিখিত বিষয়গুলো শিশুর চরিত্র গঠনে অবশই খেয়াল রাখতে হবে।
শিশুর শিষ্টতা অর্জনের জন্যে শিশুকে ভালো পরিবেশ দিতে হবে। কারণ পরিবেশের প্রভাব শিশুর চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি শিশুর প্রগাঢ় বন্ধু হলো তার পরিবারের সদস্যরা। শিশুরা অনুকরণ প্রিয় হয়ে থাকে। তাই শিশু যাতে শিষ্ঠাচারের শিক্ষা পায় তার জন্যে পরিবারের সদস্যদের উত্তম চরিত্রের হতে হবে।
একজন শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজ সহপাঠীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে। তাই অভিবাবকদেরকে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার্থী কেমন সহপাঠীদের সাথে চলাফেরা করছে।
ধর্মীয় চর্চা শিশুর চরিত্র গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত। সংস্কৃতি চর্চা ও রুচিবান মানুষের সংস্পৰ্শ শিষ্টাচার শিক্ষার অনুকল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। ভালো বইও একজন সৎ অভিভাবকের মতােই শিষ্টাচার শিখাতে সাহায্য করে।
শিষ্টাচারহীন সমাজ অন্তঃসারশূন্য বিবেকহীন। শিষ্টাচারের অভাবে মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে ফলে সমাজে দেখা দেয় হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, অন্যায় অত্যাচার, ধর্ষণ, ইভটিজং ইত্যাদি। মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে দেখা দেয় বিরোধ। মানুষ যেন হয়ে উঠে পশুর চেয়ে হিংস্র। সেই হিংস্র মানুষের থাবায় সমাজ যেন হয়ে উঠে বর্বর। সম্পর্কের ছিন্ন ঘটে, ভালোবাসাহীন হয়ে পরে সমাজ। শুধু তাই নয় অথনৈতিক দিক দিয়েও এর বিরূপ প্রভাব পরে।
শিষ্টাচারপূর্ণ সমাজ যেন এক স্বর্গের সমাজ। অন্যের দোষ জেনেও তার সাথে ভালো উত্তম আচরণ করাই শিষ্টাচারের পরিচয়। শিষ্টাচারপূর্ণ সমাজে মানুষে মানুষে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। সমাজে অন্যায় অনাচার বিরাজ করে না। সাদা-কালো বিভেদ থাকে না। সমাজ হয়ে উঠে সুন্দর স্বর্গীয়। চারিত্রিক সৌন্দর্য দ্বারা মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান অর্জন করা যায়।
লোভ, হিংসা, শঠতা, ধূর্ততা, উগ্রতা পরিহার করে সুন্দর, সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করাই হলো মানুষের দায়িত্ব ও কাজ। নম্রতা, ভদ্রতা, আচরণে, ভাষায়, কথায়, যে যত বিনয়ী সে ততই মার্জিত, আচরণে, সৌজন্য, শিষ্টাচারের মূর্ত প্রতীকের অধিকারী হয়। বিনয় আর উদারতা সব শিষ্টাচারের উৎসস্থল। বিনয় ও শিষ্টাচার ব্যক্তিত্বকে সমুজ্জ্বল করে। সকল শ্রেণীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা আর মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়। আমিত্ব পূজায় প্রচার, প্রসার হয় না। অন্যকে ছোট ভাবা উচিত নয়। পরশ্রীকাতর নামক অসুখ ভয়ঙ্কর। হিংসার লালন-পালন কাম্য নয়। নৈতিক শিক্ষার চরম অবক্ষয়ে ক্ষতবিক্ষত আমাদের জীবনের মাস্তুল। নৈতিকতা, শিষ্টাচার, সৌজন্য একে অপরের সঙ্গে সুনিবিড় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুন্দর হানাহানিমুক্ত সমাজ জীবন, সুশৃঙ্খল একটি সমাজ কাঠামো তৈরিতে পরিবার ও সমাজ জীবনে এখন শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ শুধু জরুরীই নয়, বরং সময়ের বিশাল গুরুত্বপূর্ণ এক দাবি। শিশুদের এবং আগামীর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে শিষ্টতার সুকোমল নান্দনিক আদর্শ।
মার্জিত, রুচিশীল ও সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনে রাখতে পারেন বিশেষ অবদান। মানুষ তার উত্তম ব্যবহার ও চরিত্র দ্বারা পরিবারসহ সমাজকে অলোকিত করতে পারে। পক্ষান্তরে, আশঙ্কা ও কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি শিষ্টাচারের অন্তরায় তা প্রতিনিয়ত মানবিক মূল্যবােধগুলাে ধ্বংস করে ব্যক্তির চরিত্রকে কলুষিত করতে থাকে। মূল্যবােধের চরম অবক্ষয়ে জাতি হয়ে পড়তে পারে দুর্বল ও ক্ষীণাপ্রাণ। সাম্প্রতিককালে তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে যে অশােভনতা, ঔদ্ধত্য ও উচ্ছলতার প্রকাশ ঘটছে তা পরিভােগপ্রবণ পণ্যসংস্কৃতি বিস্তারের ফল। এটা জাতির লাবণ্যহীন হওয়ারই লক্ষণ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সুস্থতা ও সমন্ধি আর্জনে তাই আমাদের শিষ্টাচারের চর্চা করা উচিত। কেননা শিষ্টাচারই একজন মানুষের প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার মূলভিত্তি।
–আদিত্ব্য কামাল, বার্তা সম্পাদক ‘জনতার খবর’