জনতার খবর ডেস্ক : চোখের পলকে যাচ্ছে দিন। বাঁধন হারা সময়। প্রভাত বেলায় কলকাকলিতে উড়ে যাওয়া পাখির ডানায় রোদ্রের গন্ধ মুছে ফেলতে না ফেলতেই সন্ধ্যা নামে। সময়ের সেই শব্দ পিছে পিছে আসে। দিন আসে দিন যায়। বাড়ে পৃথিবীর বয়স। আজ পশ্চিমে লালিমা ছড়িয়ে নিকষ আঁধারের নেকাব টেনে সূর্য বিদায় নেবে মহাকালের যাত্রায়। ঝরা পল্লবের মতো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে পড়বে ‘২০২৩’। ফেলে আসা বছরটি এখন ‘পুরোনো সেই দিনের কথা।’ নববর্ষকে আহ্বান জানিয়ে ফুরাবে এ বছরের সব লেনদেন। বিদায় অভাবনীয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ২০২৩।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে শুরু হওয়া বছরটিতে বাজারে দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ, বড় বড় আলোচিত কয়েকটি মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা, মার্কিন ভিসা-নীতি, ডলার-সংকট, রিজার্ভের অবনমন, ঋণে অনিয়ম, ডলারের দামে রেকর্ড, পোশাকশিল্পে মজুরি আন্দোলন ঘুরেফিরে এসেছে। বিশ্ব পটভূমিতে গাজায় দখলদার ইসরাইলের নৃশংসতার বিভীষিকা, আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলে অভ্যুত্থান-বলয়ের পরিধি বৃদ্ধি, ইউক্রেনে রাশিয়ার অব্যাহত অভিযানে দুই ভাগে বিভক্ত বিশ্বে নানা যুদ্ধবিগ্রহ, সহিংসতায় প্রাণহানি-গভীর সংকট, অর্থনৈতিক বিপর্যয়,ঘটনা-দুর্ঘটনায় আলোড়ন রেখে গেল বিদায়ি বছরটি। বাংলাদেশ হারিয়েছে তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানী-গুণী জনকে। বহু সংকট-জটিলতায় আক্রান্ত করেছে বিশ্বসহ বাংলাদেশকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে অর্থনীতি-বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব পুরো বিশ্বকে বিদায়ি বছরেও আক্রান্ত করেছে। ফেলে আসা বছরের আলোচিত ঘটনা ছিল বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যাত্রা, দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পানির তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল টানেল যুগে প্রবেশ, রেলগাড়ির মাধ্যমে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের সংযোগ, ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের পুরোটা সচল, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ‘সফট ওপেনিং, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন হয়েছে বিদায়ি বছরে। বিদায়ি বছরে থেকে থেকে প্রায় পুরো সময়েই বাজারে উত্তাপ ছড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম। হঠাৎ করেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, মাছ, মাংস, ডিম ও শাকসবজির দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একপর্যায়ে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দামও নির্ধারণ করে দিতে হয়েছে সরকারকে। এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। একমাত্র দাওয়াই হিসেবে সামনে এসেছে আমদানি। তবে তাতে খুব একটা ফল আসেনি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ জন। ডেঙ্গু জ্বর শহরের সমস্যা ছিল দীর্ঘদিন। যা শুধু বর্ষা মৌসুমেই থাকত। এবার ডেঙ্গু শহর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও। আর পরিণত হয়েছে সারা বছরের সমস্যায়। বিদায়ি বছর ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে। এমনকি এক পর্যায়ে এর বিনিময় মূল্য ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে এ দাম ১২৯ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকও আমদানিতে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না। ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন আমদানিকারকরা। এতে দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে, যা এখনো অস্বস্তিকর পর্যায়ে রয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।
চলতি বছরের ২৪ মে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের জন্য ভিসা-নীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে আমেরিকা। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা দেবে বা এই কাজে সহযোগিতা করবে তাদের ভিসা দেবে না আমেরিকা। এই ভিসা-নীতিতে দেশের বর্তমান-সাবেক-সরকারি-বিরোধীদলী
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচন ঘিরে সারা বছরই উত্তাপ-উত্তেজনা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। আগামী ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৬৩টি রাজনৈতিক দল। সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি আদায়ে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচি তপসিল ঘোষণার পর গতি পায়। তারা দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে সর্বসাধারণের প্রতি সরকারকে অসহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদধারীসহ বেশ কয়েক জন জননেতা দল ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেন। সাংগঠনিক ও ভোটের মাঠে এই নেতাদের তেমন গুরুত্ব না থাকলেও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীককে শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে চলে যাওয়া আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার পাশাপাশি বছর জুড়েই দলের চেয়ারপারসন অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ইস্যুটিও ছিল বিএনপির আলোচনার কেন্দ্রে। বিদায়ি বছরে আমরা হারিয়েছি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আবদুল মালিক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, চিত্রনায়ক ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, চলচ্চিত্র নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান, চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী প্রমুখকে। এত কিছুর পরেও জীবনযাত্রা থেমে নেই। এখন জড়তা, ভয়কে পাশে ঠেলে আবার জাগছে মানুষ নতুন স্বাভাবিকতায়। সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে থাকে কিছু আনন্দ-বেদনার কাব্য, আশা আর অপরিমেয় প্রত্যাশা।